 
                  বিশেষ প্রতিবেদন
২৫শে মার্চ সকালে জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পার্টির জে. এ. রহিম ও মোস্তফা খারকেসহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা করনে। ঐদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সামরিক জান্তার কারও আলোচনা হয়নি।
বঙ্গবন্ধু, এ. এইচ. এম. কারুজ্জামান, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ডঃ কামাল হোসেন ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে নিয়ে প্রায় সারাক্ষণ নীচের লাইব্রেরী রুমে বসে ছিলেন। সেদিন সবার চোখে-মুখে ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ। মাঝে মধ্যে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য ছাত্র ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এক এক করে বিদায় দেন। রহস্যের ব্যাপার, সেদিন খন্দকার মোশতাক আহমদকে কখনও দেখা যায়নি। বিকেল তিনটার দিকে শেখ ফজলুল হক মণি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর শয়নকক্ষে আলাপ করেনা এর কিছুক্ষণ পর লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা জাকারিয়া চৌধুরী বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোপনে আলাপ করেন। আলাপ শেষে প্রথমে শেখ মনি তার পরিবারের সকলকে নিয়ে সে রাতে টুঙ্গিপাড়া চলে যাবে বলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেয়। জাকারিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমাকে জানান যে, তিনি ঐ রাতেই বর্ডার পার হয়ে লন্ডন চলে যাবেন।
২৫। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যে সাতটার আগেই একে একে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য অঙ্গদলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁর নির্দেশ নিয়ে চলে যান। সন্ধ্যায় আসে ছাত্র নেতৃবৃন্দ। রাত ৮টায় এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম পুনরায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। সে সময় আমি হাসিনাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে অস্থির হয়ে পায়চারী করছিলাম। রাত যতোই বাড়তে থাকে ততোই চারদিকে লোকজন ও যানবাহনের চলাচল কমতে থাকে। চারদিক থমথমে অবস্থা লক্ষ্য করে আমি শঙ্কিত হই। যাহোক, ব্যস্ততার কারণে বঙ্গবন্ধুর রাতে যেতে দেরী হবে এই ভেবে শাশুড়ী বাদে আমরা সবাই পূর্বের নিয়ম ভঙ্গ করে সাড়ে ন’টার দিকে খেয়ে নিই। অতঃপর শেখ কামাল সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।
২৬। রাত ১১টার দিকেও বঙ্গবন্ধু ওপরে আসছেন না দেখে হাসিনা আমাকে বলে, “আব্বা সারা বিকেল কিছুই খাননি। চলো আমরা দু’জন নীচে গিয়ে আব্বাকে নিয়ে আসি।” আমরা নিচে নামার সময় দেখি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেষ কথা বলছেন সিরাজুল আলম খান, আ. স. ম. আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজকে। তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে বঙ্গবন্ধু হাসিনাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মা তোকে আমি সারাদিন দেখিনি।” এ সময় বঙ্গবন্ধুর চোখ ছিলো টক্টকে লাল। রাত সাড়ে এগারটার দিকে নীচ থেকে কাজের লোকদের একজন উপরে এস জানায় যে, “ঝন্টু” নামের এক যুবক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। বঙ্গবন্ধু বললেন, “ওর কথাই তো আমি ভাবছি। ওয়াজেদ, তুমি ওকে ওপরে নিয়ে এসো।” ঝন্টু নামক ঐ যুবকটি নিজেকে লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগের নেতা জাকারিয়া চৌধুরীর ছোট ভাই বলে পরিচয় দিলেন। কিন্তু তাঁকে আমি চিনি না বলে বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী ছাত্র লীগের মহিউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে যাই। বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে
তিনি বললেন, ‘মুজিব ভাই, পাকিস্তান আর্মিরা আপনাকে মারতে আসছে, আপনি এক্ষুণি বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তারা ট্যাঙ্ক, কামান ও তারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইতিপূর্বেই ঢাকা শহরে প্রবেশ করার জন্যে তৈরী হয়েছে।” তারা আর কি পরিকল্পনা করেছে বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলে তিনি জানান যে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স, ইপিআর বাহিনীর পিলখানাস্থ সদর দফতরে সশস্ত্র আক্রমণ চালাবে এবং সারা ঢাকার রাস্তায় যাদেরকে পাবে, তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাবে এবং রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন কেন্দ্র, টেলিকমিউনিকেশন কেন্দ্র ও ঢাকার ফুড গোডাউন বল প্রয়োগ করে পুনর্দখল করবে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে চিৎকার করে ডেকে হাসিনা, রেহানা ও জেলীকে নিয়ে আমাদের ভাড়াকৃত ফ্ল্যাটে চলে যেতে বলেন। এ খবর শোনার পর আমি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়াহিয়া খান এখন কোথায়? তিনি বললেন, ‘আমি বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছি যে, ইয়াহিয়া খান বিকেল পাঁচটার দিকে বেইলী রোডের রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন।” অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তিনি কোথায় যাবেন এবং কামাল, জামালকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবো কিনা। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার এখন অন্যত্র চলে যাওয়ার কোন উপায় নেই। তাই তারা আমাকে মারতে চাইলে এ বাসাতেই মারতে হবে। কামাল অন্যত্র চলে গেছে। জামাল ওর মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না, সে আমাদের সঙ্গে থাকবে।” এ কথা শোনার পর হাসিনা, রেহানা ও জেলী বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
২৭। ‘ওরা পরে যাবে”, শাশুড়ী এ কথা বলায় আমি তড়িঘড়ি করে মাত্র একটি স্যুটকেস নিয়ে গাড়ি চালিয়ে রওনা দিই, কিন্তু গেইটে পৌঁছে দেখি চারদিকে থমথমে অবস্থা এবং বেশ কিছু অপরিচিত লোক বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে ও লেকের ধারে টহল দিচ্ছে। আমি আমার নতুন ভাড়া বাড়ীতে পৌঁছাই বারটার দিকে। সেখানে দেখতে পাই অনেক বাঙালী ছাত্র-জনতা সাত মসজিদ রোডে বিরাট গর্ত তৈরী করছে যাতে পাকিস্তান আর্মির লোকেরা সহজে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে না পারে। বাসায় ঢুকে বিছানার চাদর দিয়ে জানালায় পর্দা লাগিয়ে ফ্লোরে শোয়ার ব্যবস্থা করি। এর মিনিট বিশেক পর হাসিনা, রেহানা, জেলী ও যে যুবকটি ইতোপূর্বে অনেক বছর যাবত বঙ্গবন্ধুর বাসায় নানান কাজকর্মের দেখাশুনা করতো সেই ওয়াহিদুর রহমান পাগলাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়ীতে সেখানে পৌঁছায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক, বিশেষ করে ইপিআর-এর পিলখানাস্থ হেড কোয়ার্টারের দিকে গোলাগুলি ও কামানের আওয়াজ শুনতে পাই। হাসিনাদের মাঝের রুমে শোয়ার ব্যবস্থা করে আমি ফ্লাটের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাশের রুমে শুয়ে থাকি। রাইফেলের গুলি আমাদের বাসায় পড়তে শুরু করলে দু’টো রুমের মাঝখানে ড্রেসিং রুমের ভেতর হারিকেন জ্বেলে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর আর্মির কয়েকটি গাড়ী বাসার পাশের রাস্তা হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে চলে যায়। রাত ২টার দিকে আমাদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল কয়েকবার বাজানো হয়। কিন্তু আর্মির লোক হতে পারে এই ভেবে আমি সাড়া দিলাম না। ভোর পাঁচটার দিকে মাইকে উর্দু ও জড়তাপূর্ণ বাংলায় রাস্তায় রাস্তায় ঘোষণা দেয়া হয়, “সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। ঘরের বাইরে আসা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ বাইরে এলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। যাদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।”
২৮। ২৫শে মার্চ রাতে সুযোগের অভাবে ঐ ফ্ল্যাটে নাস্তা কিংবা খাবারের জন্যে কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিলো না। যাহোক, ঐ রাতে পাগলা বুদ্ধি করে যে কিছু চাল, ডাল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ ও রান্নার তেল এনেছিলো সেই ছিলো আমাদের একমাত্র ভরসা। ২৬শে মার্চ বিকেলের দিকে কামালের এক বন্ধু গোপনে অনেক বাড়ীর দেয়াল টপকিয়ে এসে আমাদের • জানায় যে, পাকিস্তানী আর্মি রাত একটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে প্রবেশ করে তাঁকে, তাঁর সহকর্মী জনাব গোলাম মোরশেদ, কাজের লোক আজিজ, ফরিদ, বাবুর্চি নিয়াজ ও শিশু রাসেলকে দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত আজিজুন নেছা (বুড়ী)-কে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। গোলাম মোর্শেদকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আহত করে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে গেছে। শাশুড়ী, জামাল ও রাসেল বাসায় আছে। কামাল অন্যত্র তার বন্ধুদের সঙ্গে আছে। ঐ যুবকটি আরও জানায় যে, তথাকথিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার ২ নম্বর আসামী অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় ২৫শে মার্চ রাত বারটার পর পরই অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর লোকজন তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর লাশ ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। এ কথা শুনে পাগলা তৎক্ষণাৎ কারফিউ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে চলে যায়।
২৬শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর আলোচনার ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ দায়ী করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পুনঃসামরিক শাসন জারি করেন। ঐ ভাষণে শক্তি প্রয়োগের আদেশ প্রদান এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ দলকে বেআইনী ঘোষণা করার কথাও উল্লেখ করা হয়। ২৭শে মার্চ ভোর সকালে রেডিও ও মাইকে বার বার ঘোষণা করা হয় যে, ঐদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হবে এবং সকল সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত দফতর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যেতে হবে। পরে জানতে পারি যে, পাকিস্তান সৈন্যরা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনার বিধ্বস্ত করেছে। ইকবাল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহরুল হক) হলে ৫০-৬০ জন ছাত্রসহ হলের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। জগন্নাথ হলে শতাধিক ছাত্রকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। ২৬ তারিখে দিনের বেলায় ঐ সমস্ত নিহত ছাত্রদের দেহগুলো হলের সামনের মাঠে জ্বালানি কাঠের মত স্তূপীকৃত করে রাখা অবস্থায় দেখা গিয়েছিলো। রাতে মৃতদেহগুলোকে কবর দেয়ার জন্য কয়েকজন ছাত্রকে দিয়ে বৃহৎ গর্ত খোঁড়ানো হয়। পরে তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করেছিলো পকিস্তানী সৈন্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের চত্বরে একটি ক্যান্টিন চালাতেন সর্বজনপরিচিত ‘মধু দা”। তার দু’কন্যা, এক পুত্র ও স্ত্রীসহ তাঁকেও গুলি করে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানী সৈন্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবনগুলোয় ঢুকে অধ্যাপক ড: গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ ১১ জন অধ্যাপক ও প্রভাষককেও পাকিস্তানী সৈন্যরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের পর। দৈনিক ইত্তেফাকের অফিসসহ সব কিছু জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।

 
                         
         
         
        