আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) কঠোর শর্তে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করার প্রেক্ষাপট, প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব। কঠোর গোপনীয়তার চাদরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিলুপ্তি: পরিবর্তনের পথে না প্রতিরোধের শুরু?

১২ মে ২০২৫: সোমবার রাত। যখন সাধারণ মানুষ দিনের শেষে বিশ্রামে, তখন একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রজ্ঞাপন চুপিসারে জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই ঘোষণায় বিলুপ্ত করা হয় দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অন্যতম ভিত্তি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (IRD)। তড়িঘড়ি করে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) দেওয়া সংস্কার শর্ত, যার উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব খাতে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানো।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সিদ্ধান্ত কি কেবল আর্থিক সংস্কারের ধাপ, নাকি দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সূচনা?
নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এনবিআর ও আইআরডি বিলুপ্ত করে দুটি আলাদা বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ—গঠিত হবে। সরকার বলছে, এই কাঠামো রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা বাড়াবে, কর কাঠামো আরও ডিজিটাল ও কার্যকর হবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, কর্মকর্তারা প্রায় অন্ধকারে থেকেই পেয়েছেন এই খবর, কোনো ধরনের পূর্বপরিকল্পিত আলোচনার সুযোগই দেওয়া হয়না।
১২ মে সন্ধ্যায় এনবিআর কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠকে বসেন এবং দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা আলোচনা শেষে ঘোষণা দেন—মঙ্গলবার (১৩ মে) বিকেল তিনটা থেকে এনবিআর ভবনে অবস্থান ধর্মঘট পালিত হবে। এ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে এই আন্দোলন শুরু হলেও, এটি জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের কর্মবিরতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকার IMF-এর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে, যার অন্যতম শর্ত হলো রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত সংস্কার। ২০২3 সালের ঋণ চুক্তিতে রাজস্ব আদায়ের জিডিপি অনুপাতে বাড়ানোর চাপ ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই শর্ত পূরণের পথ কি দেশীয় বাস্তবতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ছিল দেশের অন্যতম পুরনো ও কার্যকর প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। এর বিলুপ্তি এবং নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা রাজস্ব আদায়ের ধারাবাহিকতা ব্যাহত করতে পারে। একইসাথে কর্মকর্তাদের আস্থাহীনতা, প্রতিবাদ ও ধর্মঘট সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলায় বড় ধাক্কা দিতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্ত যুগোপযোগী এবং রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করবে। কিন্তু গোপনীয়তার চাদরে মোড়ানো প্রক্রিয়া, সংশ্লিষ্টদের মতামতহীনতা এবং তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়নের ধারা গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক নীতির পরিপন্থী।
অতএব, প্রশ্ন থেকেই যায়—এই পরিবর্তন উন্নয়নের অগ্রদূত, না কি অর্থনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল?
