২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের বাইরে গেছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা নগদ অর্থ। অর্থনীতিবিদরা এটিকে কর ফাঁকি, অনানুষ্ঠানিক লেনদেন ও আর্থিক অনাস্থার প্রতিফলন বলে মনে করছেন। বিশ্লেষণ করলেন আমাদের প্রতিবেদক

দুই বিপরীত স্রোত: একদিকে আমানত, অন্যদিকে নগদ উত্তোলন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৪ শেষে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮.৫১ শতাংশ, যা বিগত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে আমানতের মোট পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ১৮০ কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকায়, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা—এক মাসে বৃদ্ধি ২৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা বা ৯.১৮ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই দুই বিপরীত স্রোত আমাদের অর্থনীতিতে বিদ্যমান আস্থার ঘাটতি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের বৈষম্য এবং কাঠামোগত দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
এক মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে যাওয়াকে ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাদের মতে, এই অর্থের বেশিরভাগ অংশ গিয়েছে—
- অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেখানে হিসাবের বাইরে লেনদেন চলে),
- কর ফাঁকির লক্ষ্যে নগদ লেনদেন,
- এবং ঈদ ও রমজানকেন্দ্রিক ভোক্তাচাহিদা মেটাতে ব্যক্তিগত খরচে।
বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আলী বলেন, “ঈদের আগে মানুষ অনেক সময় প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য বাড়তি নগদ অর্থ তুলে রাখে, এটি বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে একটি পরিচিত প্রবণতা।”
যদিও ঈদকে কেন্দ্র করে নগদ উত্তোলনের একটি চক্রাকার প্রভাব থাকে, তবু চলতি বছরের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অনেক বেশি গভীর। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এটি নিছক ‘ঈদের খরচ’ নয়—এটি আর্থিক খাতে আস্থার সংকটের প্রমাণ। সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকে কিছুটা আস্থা ফিরলেও, একই সময়ে নগদ প্রবাহ বৃদ্ধির প্রবণতা বোঝায় যে মানুষ এখনো ব্যাংকিং সিস্টেমে সম্পূর্ণ আস্থাশীল নয়।নগদ প্রবাহের এই বৃদ্ধি শুধু আর্থিক ব্যবস্থার জন্য নয়, সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থার জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নগদ লেনদেন বাড়লে ডিজিটাল পেমেন্ট কমে, ফলে করদাতার সংখ্যা কমে, এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ে সংকট দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এই সংকট উত্তরণে যেসব সুপারিশ করেছেন:
- ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা
- ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করা
- নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন
- সুদহার প্রতিযোগিতামূলক রাখা
- ব্যাংক গ্রাহকদের জন্য উন্নত সেবা নিশ্চিত করা
এক মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো নগদ অর্থ ব্যাংকের বাইরে চলে যাওয়ার বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি আর্থিক-সামাজিক সংকেত, যা নীতিনির্ধারকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এখনো আস্থা ফেরেনি পুরোপুরি। এর থেকে উত্তরণে শুধু আর্থিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সংস্কার জরুরি।

 
                         
         
         
        