 
                  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনায় শিক্ষাঙ্গন, প্রশাসন এবং রাজনীতির জটিল সম্পর্ক আবারও সামনে এলো। বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনটি পড়ুন।
বিকেলবেলা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) গেটসংলগ্ন এলাকায় এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বয়ঃবৃদ্ধ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযুক্ত, একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। মামলার বাদী—সদ্য সাবেক ছাত্রদল নেতা সুজন মোল্লা। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু।
সূত্রাপুর থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম জানান, “গোপন সংবাদের ভিত্তিতে” ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে আনোয়ারা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অথচ, জানা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ‘আপগ্রেডেশন বোর্ড’ মিটিংয়ে যোগদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত চিঠিতে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান কেউই তার আগমন সম্পর্কে জানতেন না বলে দাবি করেছেন। বিষয়টি প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতির দিকেও ইঙ্গিত দেয়।
এই মামলার বাদী সুজন মোল্লা বলেন, “আনোয়ারা বেগম দলকানা শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছাত্রদল-শিবিরকে রাজাকার বলতেন, বিসিএসে ছাত্রলীগ ছাড়া কাউকে উত্তীর্ণ করতেন না।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “জুলাই আন্দোলনে ছাত্রলীগকে টাকা দিয়ে আমাদের উপর গুলি করিয়েছেন।” যদিও এসব অভিযোগের পক্ষে এখনও কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন নেই।
এর আগে ফেব্রুয়ারিতেও 'জুলাই আন্দোলন' ঘিরে আরেকটি মামলায় ১৯৩ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-ছাত্রলীগ নেতার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সুজন মোল্লা।শিক্ষা এবং আইনের শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক অভিযোগ রয়েছে যে, সুজন মোল্লা মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি ঢুকিয়ে দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছেন। যদিও তিনি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তা সত্ত্বেও প্রশ্ন রয়ে যায়—এত বিশালসংখ্যক শিক্ষকের নাম বারবার এক ব্যক্তির করা মামলায় উঠে আসা কি কাকতালীয়?
অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম ছাড়াও এই মামলায় আসামি আরও ৯ জন শিক্ষক এবং ৫ জন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা। এদের মধ্যে আছেন—
- অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী
- অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া
- অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস
- সাবেক প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল
- সহকারী প্রক্টর নিউটন হাওলাদার
- সহযোগী অধ্যাপক ফারুক আহমেদ
- সহকারী অধ্যাপক আবু সালেহ সিকান্দার
- কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি কাজী মনির
- ডেপুটি রেজিস্ট্রার আলতাফ হোসেন, ইমরান হোসেন ইমন
- সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও স্টোর কিপার টুটুল আহমেদ ও সুমন হাসান সোহান
এই গ্রেপ্তারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব, মামলাবাজি সংস্কৃতি এবং শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতির ভয়াবহ উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যদি এই গ্রেপ্তার আইনানুগ হয়, তবে কেন তার আগে প্রশাসন জানত না? আর যদি এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, তবে তাতে প্রশ্ন ওঠে—এটি কি কোনো বৃহৎ ‘ক্লিনজিং অপারেশন’-এর অংশ?
বিশ্ববিদ্যালয় যে রাজনীতির ল্যাবরেটরিতে পরিণত হয়েছে, তা আর অজানা নয়। বরং এই ঘটনাই শিক্ষা দেয়—যেখানে প্রশাসন, রাজনীতি ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা একসঙ্গে মিশে যায়, সেখানে আইনও বিভ্রান্ত হয়।
অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমের গ্রেপ্তার নিছক কোনো ফৌজদারি মামলার অংশ নয়, বরং এটি একটি প্রতীক—যেখানে শিক্ষাঙ্গনের নিরপেক্ষতা, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক শুদ্ধাচার প্রশ্নের মুখে।
এই ঘটনা এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিলো—শিক্ষক কি নিরাপদ? বিশ্ববিদ্যালয় কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত? আর শিক্ষাঙ্গনে কি সত্যিই ন্যায়বিচার সম্ভব?

 
                         
         
         
        