কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেনের বাড়িতে হামলা ও আগুন লাগানো হয়েছে। এই ঘটনা কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল? বিস্তারিত বিশ্লেষণ পড়ুন।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঘটে যাওয়া একটি অমানবিক, ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তোলে—আমরা কতটা নিরাপদ? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে যদি রাতের আঁধারে হামলা আর আগুন দেওয়া হয়, তবে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎই বা কোথায়?
মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে চৌদ্দগ্রামের গুণবতী ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রিপুর গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেনের বাড়িতে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা কেবল একটি ফৌজদারি অপরাধ নয়—এটি সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সহনশীলতার প্রতীকী বিপর্যয়।আলী হোসেন কেবল একজন মুক্তিযোদ্ধা নন; তিনি ছিলেন চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭১ সালে ফেনীর বিলনিয়া সীমান্তে ৪নং সেক্টরে অংশ নিয়েছিলেন রণাঙ্গনের যুদ্ধে। তার স্ত্রী রাশেদা আখতার নিজেও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। এই পরিবার রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক।
তাদের মতো পরিবার যদি নিজের ভিটেমাটিতে বসবাসের নিরাপত্তা না পায়, তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দেশের কী অর্জন? এটি কি শুধুই জমিজমা বা স্থানীয় বিরোধের ফসল? নাকি রাজনীতির প্রতিহিংসামূলক আগুন?
রাত দেড়টার দিকে দুর্বৃত্তরা দরজা-জানালা ভেঙে ঘরে ঢোকে, ভাঙচুর চালায় এবং পরবর্তীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়িটিতে তদারকির দায়িত্বে ছিলেন জামশেদ আলম, যিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই বসবাস করতেন। ভাগ্যক্রমে তারা প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু আতঙ্কের ছাপ রয়েছে তাদের চোখে-মুখে।
স্থানীয়রা বলছেন, হামলাকারীরা সুপরিকল্পিতভাবে রাতের নির্জনতায় এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এ ধরনের পৈশাচিক কাজ কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা বলেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি মোহাম্মদ হিলাল উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং তদন্ত শুরু করেছে। তবে এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।
প্রশ্ন হলো—এই ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রশাসন কতটা তৎপর? কেন আগের হামলার পরও বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি?
রাশেদা আখতার জানিয়েছেন, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকেই তারা অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হুমকির মুখে গ্রামে যেতে পারছেন না। এমনকি আগেও একবার একই বাড়িতে হামলা হয়েছে।
তাহলে কেন এই পরিবারটি কোনো নিরাপত্তা পায়নি? কিসের ইঙ্গিত এই নিষ্ক্রিয়তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে ভিন্নমত দমন, প্রভাব বিস্তার, এবং দলীয় দ্বন্দ্ব থেকে সহিংসতার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের ওপর এই ধরনের হামলা জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকা পরিবারকে যদি এমন হুমকি, নিপীড়ন সহ্য করতে হয়, তাহলে যারা এই চেতনার বিরুদ্ধে, তারা আরও উৎসাহিত হয় না?
চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে হামলা কেবল একটি স্থানিক ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি অশনিসংকেত। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন—সব মিলে সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতির ভদ্রপথিকদের ভীত করে তোলে।
সরকার ও প্রশাসনের উচিত দ্রুত এই ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শনাক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কারণ এ আগুন নিছক একটি ঘরে নয়, জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুকে ছ্যাঁকা দিয়েছে।

 
                         
         
         
        