 
                  চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর বিওসি ঘাট এলাকায় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে চোরাই তেল ব্যবসা ও ঘাট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা স্থানীয় রাজনীতির নিচুস্তরের এক বিপজ্জনক বাস্তবতাকে উন্মোচিত করেছে। বিশ্লেষণ করলেন আমাদের প্রতিবেদক।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়নের ডাঙ্গারচর ৯ নম্বর বিওসি ঘাট এলাকায় সম্প্রতি সংঘটিত সংঘর্ষটি প্রথম দেখায় স্থানীয় দুইটি রাজনৈতিক গ্রুপের সংঘাত মনে হলেও, গভীরে প্রবেশ করলে স্পষ্ট হয়—এটি ছিল একটি অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই।
চোরাই তেল বা ‘পিলাই তেল’ ব্যবসা এবং ঘাটের নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কেবল রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং টিকে থাকার অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী নদীঘেঁষা এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই চোরাই তেলের রমরমা ব্যবসা চলছে। একসময় এর একক নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগপন্থী নেতা আব্দুল শুক্কুর ওরফে ‘তেল শুক্কুর’-এর হাতে।
তবে ২০২৪ সালের আগস্টে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিএনপি এলাকায় সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলে এই ব্যবসায়ও তাদের হস্তক্ষেপ বাড়ে।
প্রাথমিকভাবে দুই গ্রুপ ১৫ দিন করে ভাগাভাগি করে তেল ব্যবসা চালানোর সমঝোতায় পৌঁছায়। কিন্তু দখলদার মনোভাব ও ক্ষমতার লোভ থেকে এক পক্ষ একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় গেলে বিরোধ চরমে পৌঁছায়।
এই সংঘর্ষ শুধুমাত্র ঘাট নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল ক্ষমতার প্রদর্শনী—কে এলাকার ‘বাস্তব কর্তৃত্ব’ বহন করছে, তার প্রমাণ দেওয়ার এক ধরনের অস্ত্র-ভিত্তিক রাজনীতি। এমন ঘটনায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে আনা প্রশাসনের সফল পদক্ষেপ হলেও এটি বৃহৎ এক সামাজিক ব্যর্থতাও নির্দেশ করে—যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো সাংগঠনিক আদর্শ নয়, বরং স্থানীয় অবৈধ অর্থনীতির অংশীদারিত্বে মগ্ন।
সংঘর্ষের পর সেনাবাহিনী জুলধা ইউনিয়ন ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি বাহারসহ চারজনকে আটক করলেও, থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগ হয়নি। কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফের ভাষ্যেও এই নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট। এ ধরনের ঘটনাগুলো বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।
এটি কোনো সাধারণ সংঘর্ষ নয়—এটি রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে সংগঠিত এক ধরনের প্যারালাল ইকোনমির প্রতিচ্ছবি।
যেখানে রাজনীতির মঞ্চের পেছনে চলছে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ, তেলের ভাগবাটোয়ারা, আর সংঘর্ষের মধ্যে বসবাস করছে সাধারণ জনগণ।
এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মী নয়, দুর্বৃত্তরাই শক্তি সঞ্চয় করছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর এই ঘটনা বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতির একটি গোপন অথচ স্বাভাবিক হয়ে উঠা বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
যেখানে রাজনৈতিক পরিচয়ের অন্তরালে লুকিয়ে আছে অবৈধ অর্থনীতির সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা এক প্রজন্ম।
এই অবস্থা চলতে থাকলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতাই নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।

 
                         
         
         
         
         
        