 
                  মায়ানমার ও আরাকান করিডোর নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা, নিরাপত্তা ঝুঁকি, সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন!
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ছায়ায় এক নতুন ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন উঠে এসেছে—আহত ও বাস্তুচ্যুতদের জন্য একটি ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপনের প্রস্তাব। তবে এ সিদ্ধান্ত আদৌ কাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া হয়েছে এবং এর জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে—এই প্রশ্নগুলো এখন ঘূর্ণায়মান। নিচে বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হলো:
১. মায়ানমার কি এই করিডোরে রাজি হয়েছিল?
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মায়ানমারের জান্তা সরকার এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান দেয়নি। বরং আরাকান সেনাবাহিনী (Arakan Army) এবং জান্তা সরকারের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমন করিডোর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মায়ানমার সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্মতি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়।
২. মায়ানমার এবং আরাকান সেনাবাহিনীর সম্পর্ক কী?
এই সম্পর্ক এক কথায় বলা যায়—”খারাপ থেকে কুৎসিত”।
আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং রাখাইনদের অধিকারের দাবিতে লড়ছে, অন্যদিকে জান্তা সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দমন করছে।
এদের দ্বন্দ্ব নিয়মিত সংঘর্ষ এবং বাস্তুচ্যুত জনগণের জন্ম দিচ্ছে। ফলে, কোনো করিডোর বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে আরাকান আর্মির প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না।
৩. এই করিডোর কি মায়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের গতিশীলতা তৈরি করবে?
তাত্ত্বিকভাবে এটি মানবিক সহায়তার বার্তা দিতে পারে, তবে বাস্তবে এটি বাংলাদেশের কাঁধে অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারে।
যদি এই করিডোর স্থায়ী বাস্তুচ্যুতি বা সীমান্ত লঙ্ঘনের পথ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে।
৪. প্রধান নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে পরামর্শ না করেই কি এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত?
না। যেকোনও সীমান্ত সংশ্লিষ্ট বা নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় অপরিহার্য।
৫. সশস্ত্র বাহিনীকে কেন তাদের অবস্থান সম্পর্কে সকলকে ব্যাখ্যা করতে হবে?
প্রশ্নটি উল্টো করা যেতে পারে—সরকার কেন তাদের সাথে পরামর্শ করে না? বাহিনীর অবস্থান রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অপরিহার্য। যদি কোনো সিদ্ধান্তে সামরিক ঝুঁকি থাকে, বাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি।
৬. এই সরকার কি সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ না করেই এত বড় সিদ্ধান্ত নেবে?
বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অনেক সময় ‘টপ-ডাউন’ মডেল অনুসরণ করে। এতে করে নীতি ও বাস্তবতা দ্বন্দ্বে পড়ে।
করিডোরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত মতামত প্রয়োজন।
৭. ভারত যদি শান্তিবাহিনীর জন্য একটি মানবিক করিডোরের ব্যবস্থা করত, তাহলে বাংলাদেশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত?
উত্তর সোজা: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রতিবাদ করত।
ঠিক একইভাবে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের সীমান্তে এ ধরনের ‘মানবিক’ উদ্যোগ নিত, তাহলে তা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হতো।
৮. এই সরকারের মূল আদেশ কী?
সরকারের মূল আদেশ হওয়া উচিত জাতীয় স্বার্থ, সীমান্ত নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা। দুঃখজনকভাবে, কিছু কিছু সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে তা জনপ্রিয়তা বা আন্তর্জাতিক তোষণের ওপর নির্ভরশীল।
৯. এই মানবিক করিডোরের জন্য কে অনুরোধ করেছিল?
এ প্রশ্নটির উত্তর অজানা। জাতিসংঘ বা আইওএম এ ধরনের অনুরোধ জানিয়েছে কি না, তাও স্পষ্ট নয়। ফলে, এটি স্বতঃস্ফূর্ত মানবিকতা না কৌশলগত চাপে নেওয়া সিদ্ধান্ত—তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
পরিশেষেঃ
 মানবিক করিডোর স্থাপন একদিকে মানবিকতা, অন্যদিকে এটি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। 
এ সিদ্ধান্ত যতোই সদিচ্ছাপূর্ণ হোক, তা যদি কৌশলগত ও সুরক্ষা বিষয়ক পর্যবেক্ষণ ছাড়া নেওয়া হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে বিপদজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

 
                         
         
         
        