বৈছা আন্দোলনের উচ্চকণ্ঠী অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন ফেসবুকে লিখেছেন, “এই দেশে আমি মোটেও নিরাপদ নই।” তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও সমাজের মৌসুমি প্রতিবাদ নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ।
“এই দেশে আমি কি নিরাপদ?”—একটি সহজ প্রশ্ন। অথচ এর উত্তর যেন প্রতিটি নারীর জীবনে জড়িয়ে থাকা কঠিনতম সত্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (বৈছা) উচ্চকণ্ঠী অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধনের সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসটিতে এই প্রশ্নই প্রতিধ্বনিত হলো। তার কণ্ঠে ক্ষোভ, হতাশা আর প্রতিবাদের এক অভ্যন্তরীণ আগুন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা শুধু তার নয়, আমাদের সবারই অদৃশ্য আতঙ্ককে স্পর্শ করছে।
বাঁধন লিখেছেন, “না। মোটেও না।”
তিনি এই “না” উচ্চারণ করেছেন তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও অভিজ্ঞতার জমাট হয়ে থাকা অন্ধকার থেকে। আমাদের দেশে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে যে বুলির প্রচলন আছে, সেটিকে নৃশংস বাস্তবতার আয়নায় ভেঙে টুকরো করে দিয়েছেন তিনি।
তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে তিনটি মূল ইস্যু—
প্রাত্যহিক সহিংসতা ও হয়রানি
দুর্নীতিগ্রস্ত, পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্লিপ্ততা
সমাজের ‘মৌসুমি প্রতিবাদ’-এর ভঙ্গুরতা
বাঁধন তার পোস্টে লিখেছেন, “প্রতিদিনের দৃশ্যপটে নারীরা হচ্ছেন নির্যাতনের শিকার। হেনস্তা, হয়রানি, হুমকি— আর এই তালিকা কখনও ফুরায় না।”
আমরা প্রায়ই দেখি—কোনো নারীর প্রতি সহিংসতা চরম আকার ধারণ করলে সোশ্যাল মিডিয়া তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে। হ্যাশট্যাগে ছেয়ে যায় নিউজফিড। কয়েকদিনের ‘শোক’ আর ‘ক্রোধ’—তারপর আবার নীরবতা।
বাঁধনের ভাষায়, “আমরা যেন এক অদ্ভুত চক্রে বন্দি হয়ে পড়েছি, যেখানে ক্ষোভ আর কান্না অল্প সময়েই ঝিমিয়ে পড়ে।”
এ যেন সমাজের সীমিত সহানুভূতির এক নিষ্ঠুর চিত্র। যতক্ষণ না কোনো মৃত্যু ঘটে, ততক্ষণ যেন নারীর আতঙ্ক “বড় কোনো খবর” হয়ে ওঠে না।
বাঁধন আরও লিখেছেন, “আমি নিজেও বহুবার অনলাইনে হুমকি পেয়েছি। গালাগাল, কুৎসা রটানো, যৌন হয়রানি—সবই সহ্য করেছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি? না।”
এই প্রশ্ন উঠছে—তাহলে রাষ্ট্র কিসের জন্য?
যখন সমাজের প্রভাবশালী, পরিচিত, সুশিক্ষিত নারীরাও ন্যায়বিচার পান না, তখন লাখো সাধারণ নারীর দুর্দশার পরিসর কতো ভয়াবহ হতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়।
বাঁধনের অভিজ্ঞতা দেখায়—“তাদের চোখে আমি এসবেরই যোগ্য। যতক্ষণ না খুন হচ্ছি, ততক্ষণ চুপ করিয়ে দেওয়া যায়।”
এই বক্তব্য কেবল এক ব্যক্তির অভিযোগ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার অমোঘ প্রমাণ।তিনি স্বীকার করেছেন, জুলাইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মনে হয়েছিল হয়তো কিছু বদলাবে।
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিকতা, দুর্নীতি আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আবারও তাকে হতাশ করেছে।
এখন বাঁধনসহ হাজারো মানুষকে সেই কঠিন সত্যই মেনে নিতে হচ্ছে—এই রাষ্ট্রে নারীর জন্য আশাবাদী হওয়ার কোনো স্থায়ী কারণ নেই।
এমন বক্তব্য আমাদের collective conscience (সমষ্টিগত বিবেক)কে ঝাঁকুনি দেয়।
আমাদেরকে নিজের কাছে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য করে—“এই দেশে আমরা কি আসলেই নিরাপদ?”
এই প্রশ্নের উত্তরে যদি আবার “না” হয়—তাহলে আমাদের প্রতিবাদও কি মৌসুমি রাগে শেষ হয়ে যাবে, নাকি সত্যিকারের পরিবর্তনের দিকে এগোবে?
বাঁধনের কণ্ঠস্বরকে হয়তো নিছক ‘স্ট্যাটাস’ ভেবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এই কণ্ঠস্বর এক ধরনের চূড়ান্ত সতর্কবার্তা—যা উপেক্ষা করার অবকাশ আর নেই।

 
                         
         
         
        