ভোলার তজুমদ্দিনে চাঁদা না পেয়ে স্বামীকে বেঁধে মারধর ও স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ভয়াবহ ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। রাজনীতির ছত্রছায়ায় অপরাধ কতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই কলামে।
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা—একটি তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ জনপদ, সম্প্রতি এক বীভৎস ও বর্বর ঘটনার সাক্ষী হলো যা শুধু একটি নির্দিষ্ট পরিবার নয়, পুরো সমাজব্যবস্থাকে নাড়া দিয়েছে। চাঁদা না পেয়ে স্বামীকে বেঁধে রাতভর নির্যাতন এবং স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে স্থানীয় রাজনীতির অঙ্গনও এসে পড়েছে জনবিচারের কাঠগড়ায়। এ ঘটনায় শ্রমিক দল, ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসায় প্রশ্ন উঠেছে—স্থানীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় কীভাবে অপরাধীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে?
রোববার রাতের এই ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর স্বামী তজুমদ্দিন থানায় মামলা করেন ১১ জনের বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্রমিক দলের উপজেলা যুগ্ম সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, তজুমদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. রাসেল এবং তথাকথিত যুবদল কর্মী আলাউদ্দিন। মামলার বিবরণে উঠে এসেছে, পারিবারিক বিরোধের ‘নাটকীয়’ আমন্ত্রণের মাধ্যমে স্বামীকে ডেকে এনে তার ওপর চাঁদার চাপ সৃষ্টি, এরপর রাতভর শারীরিক নির্যাতন এবং শেষতক তার স্ত্রীকে ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়।
ধর্ষিত নারী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তাকে একাধিক আসামি মিলে ধর্ষণ করে। আশ্চর্যের বিষয়, এই জঘন্য ঘটনার সময় পাহারায় ছিল তারই স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী।
এমন জটিল পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দাপটকে পুঁজি করে যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা কেবল আইনশৃঙ্খলা নয়, সমাজের নৈতিক কাঠামোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে যখন স্পষ্ট অভিযোগ এসেছে, তখন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অস্বীকারের খেলা। ছাত্রদল নেতা রাসেল দাবি করেছেন, তিনি ঘটনা ফেসবুকে জেনেছেন। অন্যদিকে বিএনপির উপজেলা সদস্য সচিব ওমর আসাদ রিন্টু আশ্বাস দিয়েছেন, “দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো—ঘটনার আগে কীভাবে একজন শ্রমিক দল নেতা, একজন ছাত্রদল নেতা ও একাধিক সহযোগী এতটা নিশ্চিন্তে একটি পরিবারকে টার্গেট করতে পারে? কীভাবে চাঁদার জন্য এমন নির্মম নির্যাতন দিনের আলোয় ঘটে যায়? তাছাড়া, একাধিক রাজনীতিকের নাম এজাহারে থাকা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার না হওয়া কি রাজনীতির প্রভাবেরই নিদর্শন নয়?
তজুমদ্দিন থানার ওসি মোহাব্বত খান ও জেলা পুলিশ সুপার শরীফুল হক যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন। একজনকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, এবং ভুক্তভোগী নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া প্রাথমিকভাবে আশার সঞ্চার করলেও—অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাব তদন্তকে দীর্ঘায়িত করে দেয়। এক্ষেত্রেও যেন তার ব্যতিক্রম না হয়।
এই ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নয়—এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতা। যেদিন রাজনীতির আশ্রয়ে অপরাধীরা সমাজে কর্তৃত্ব বিস্তার করে, সেদিন সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যার চেষ্টা এবং ৯৯৯-এ ফোন করে আত্মরক্ষার আকুতি—এগুলো আমাদের বলে দেয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পৌঁছাতে একজন নারীর কতটা বাধা অতিক্রম করতে হয়।
এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা যেমন প্রশাসনের দায়িত্ব, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত—অপরাধীদের দলীয় পরিচয় দেখে আড়াল না করা। বরং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা। তা না হলে, রাজনীতি ক্রমে ‘দুই টাকা চাঁদা’ থেকে ‘জীবনকে মূল্যহীন’ করে তোলার হাতিয়ার হয়ে উঠবে—যার মূল্য দিতে হবে পুরো সমাজকে।
