 
                  বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ‘জুলাই আন্দোলনের শহীদ’ তালিকায় উঠে এসেছে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি, চোর-ডাকাত ও দুর্ঘটনায় নিহতদের নাম। অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে অন্তত ১০ জন ভুয়া শহীদের পরিচয়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর একটি গেজেট হয়ে উঠেছে ‘জুলাই আন্দোলনের শহীদ তালিকা’। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের ‘গণআন্দোলনের শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে চোখে পড়ছে অভাবনীয় সব নাম—জঙ্গি, চোর, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, এমনকি পারিবারিক খুনের ঘটনাও।
তালিকার ৩৭৫ নম্বরে রয়েছে ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান হামলায় জড়িত ও সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি জিন্নাহ মিয়ার নাম।
কাশিমপুর কারাগারে এক বন্দি বিদ্রোহের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় জিন্নাহ।
এই বিদ্রোহের সঙ্গে আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ তাকেও ‘শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
১০টি ভুয়া শহীদের চিত্র
১. মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত বিজয় (তালিকায়: ২৮ নম্বর)
দনিয়ায় একটি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে গিয়ে নিহত হন। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ ছিলেন না।
২. চট্টগ্রাম কারাফটকে পুলিশের গুলিতে নিহত নিজাম (তালিকায়: ৩৭ নম্বর)
কারাগারে হামলার চেষ্টা করেছিলেন, যা কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নয়।
৩. কেরাণীগঞ্জ কারাগারে ছিনতাই মামলার আসামি জাবেদ (তালিকায়: ১৮৭ নম্বর)
কারাগারে বিদ্রোহে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যান।
৪. বিদ্যুৎস্পৃষ্ট রকিবুল (তালিকায়: ৩২৫ নম্বর)
পতাকা টানাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে মারা যান।
৫. মিছিলে স্ট্রোকে মারা যাওয়া মামুন (তালিকায়: ৪৮৯ নম্বর)
ডাক্তারি রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
৬. হার্ট অ্যাটাকে মৃত ছমেছ উদ্দিন (তালিকায়: ৪৯৮ নম্বর)
পুলিশ দেখে দৌড়ে পালানোর সময় পড়ে গিয়ে মারা যান।
৭. কিডনি রোগে মৃত কাওছার মাহমুদ (তালিকায়: ৭৬৮ নম্বর)
দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন, আন্দোলনের সঙ্গে তার মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।
৮. ভাইয়ের হাতে খুন হওয়া আল আমিন (তালিকায়: ৭৭৬ নম্বর)
পারিবারিক দ্বন্দ্বে নিহত হন, থানায় দায়ের করা মামলায় রাজনীতি বা আন্দোলনের কোনো প্রসঙ্গ নেই।
৯. নিজের গুলিতে নিহত ইমতিয়াজ (তালিকায়: ৭৮৪ নম্বর)
চাটখিল থানায় লুটপাট করতে গিয়ে নিজের পিস্তলের গুলিতেই মারা যান।
১০. কাশিমপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হোলি আর্টিজান মামলার আসামি জিন্নাহ (তালিকায়: ৩৭৫ নম্বর)
একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত এই ব্যক্তি কীভাবে ‘আন্দোলনের শহীদ’—এ প্রশ্ন এখন জনমনে।
সরকার ঘোষিত শহীদদের জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা অনুদান, ফ্ল্যাট বরাদ্দ এবং মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই মোটা অঙ্কের প্রণোদনাই কি শহীদ বানানোর নতুন কারখানা খুলে দিয়েছে?
ছাত্র সমন্বয়করা যেসব তথ্য নিয়ে কাজ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গেজেটভুক্ত শহীদের সংখ্যার বাইরে আরও শতাধিক ব্যক্তি ‘ভুয়া শহীদ’ হিসেবে প্রচার পাচ্ছেন, যাদের আসল মৃত্যুর পেছনে আন্দোলনের বিন্দুমাত্র সংশ্লেষ নেই।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে—এই ৮৩৪ জনের মৃত্যুর ময়নাতদন্ত, প্রত্যক্ষদর্শী জবানবন্দি, থানা জিডি বা চিকিৎসা রিপোর্ট কতটা যাচাই করা হয়েছে?
যদি প্রত্যেক মৃত্যুর পেছনে প্রকৃত তদন্ত হতো, তাহলে কতজন সত্যিকারের শহীদ টিকে যেত? আর কারা পর্দার আড়াল থেকে তালিকায় ঢুকে পড়েছেন শুধুই সুবিধা পাওয়ার আশায়?
‘শহীদ’ শব্দটি আমাদের ইতিহাসে এক পবিত্র ও গৌরবময় অভিধা।
কিন্তু যদি এই শব্দ রাজনীতির প্রয়োজনে অপরাধী, জঙ্গি, পারিবারিক হত্যার শিকার কিংবা দুর্ঘটনায় মৃতদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধাও একদিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
সরকারের উচিত তালিকাটি অবিলম্বে পূনঃমূল্যায়ন করে প্রকৃত শহীদদের মর্যাদা রক্ষা করা—তাদের যারা প্রকৃতই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের জন্য জীবন দিয়েছেন।

 
                         
         
         
        