নেত্রকোনায় ইমামতি না করেও শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননা পেলেন ওলামা দলের সাবেক নেতা জসিম উদ্দিন। স্থানীয় ইমামদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বহীনতা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক।
নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার একজন ব্যক্তি—যিনি কোনো মসজিদের ইমাম নন, অথচ তিনি হয়েছেন ‘জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম’। এই খবর সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হওয়ার পর জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। যাঁর নাম উঠে এসেছে, তিনি জসিম উদ্দিন, একসময়কার উপজেলা ওলামা দলের সভাপতি এবং স্থানীয় হেফাজতপন্থী রাজনীতির পরিচিত মুখ।
তবে তাঁকে যে মসজিদের ইমাম হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেই মসজিদের স্থায়ী ইমাম রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকে সেই মসজিদে ইমামতি করছেন।
আর জসিম উদ্দিনের কোনোদিন ইমামতির সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
২০২৫ সালের ২৯ জুন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের জাতীয় সম্মেলন হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
ওই অনুষ্ঠানে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে সম্মাননা, সনদ ও আর্থিক চেক প্রদান করা হয় জসিম উদ্দিনসহ তিনজনকে।
সম্মেলনের ছবি জসিম উদ্দিন নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করলে বিষয়টি সামনে আসে। এরপর থেকে জেলাজুড়ে শুরু হয় চরম বিতর্ক ও ক্ষোভ।
নেত্রকোনা ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, জেলার ১০টি উপজেলা থেকে ২০ জন করে মোট ২০০ জন ইমামের নাম জমা পড়ে। এই তালিকা যাচাই-বাছাই করে ৩ জনকে নির্বাচিত করা হয়।
তবে যাচাই-বাছাই যে আদৌ হয়নি বা রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে, সেই অভিযোগ তুলেছেন ইমামরা।
রফিকুল ইসলাম, যিনি প্রকৃতপক্ষে ওই মসজিদের ইমাম, বলেন—“দুই যুগের বেশি সময় ধরে ইমামতি করেও তালিকায় আমাদের নাম নেই।
অথচ যিনি কোথাও ইমামতি করেন না, তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম! এটা পেশাদার ইমামদের চরম অবমূল্যায়ন।”
জসিম উদ্দিনের প্রতিবেশীরা বলছেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মডেল কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করছেন এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, কিন্তু ইমামতি কখনো করেননি।
এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে—ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মূল্যায়ন ও পুরস্কার বাছাই প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ?
স্থানীয়দের মতে, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতায় সম্মাননা হস্তান্তর, যা সরাসরি ধর্মীয় পেশাদারিত্বকে আঘাত করে।
যদি সত্যিই এমন হয় যে, একজন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্যক্তি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে শ্রেষ্ঠ ইমামের স্বীকৃতি পান, তাহলে এই ঘটনার দায় শুধু জসিম উদ্দিনের নয়—বরং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ও দায় এড়াতে পারে না।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বড় প্রশ্নটি দাঁড়িয়েছে—ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাব কতটা ব্যাপক হয়ে উঠেছে?
ওলামা দল ও হেফাজত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি প্রশাসনিক সুবিধা ও সম্মাননা পেতে পারেন, তবে সাধারণ ইমামদের আত্মমর্যাদা কোথায় থাকবে?
এই ঘটনাটি শুধু নেত্রকোনার একটি উপজেলা নয়, বরং সারা দেশের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার ওপর একটি সতর্ক সংকেত।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ভবিষ্যতে এমন বিতর্ক এড়াতে যাচাই-বাছাই পদ্ধতি আরও কঠোর করা এবং প্রকৃত ইমামদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা দরকার।
সম্মাননা তখনই সার্থক, যখন তা যোগ্য ব্যক্তির হাতে পৌঁছে। অন্যথায়, তা গোটা সমাজে বিভ্রান্তি, ক্ষোভ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে।
