 
                  কুমিল্লার চান্দিনায় সিআইডি পরিচয়ে প্রবাসীকে অপহরণ ও লুটের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন শ্রমিকদল নেতাসহ পাঁচজন। ঘটনা বিশ্লেষণে উঠে আসছে রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার, আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন ও প্রবাসীদের নিরাপত্তা সংকট।
চান্দিনার শান্ত জনপদ যেন হঠাৎ করে কোনো ক্রাইম থ্রিলারের মঞ্চে পরিণত হলো। দিন দুপুরে ঘরে বসে থাকা একজন প্রবাসীকে “সিআইডি” পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। লুট করা হলো বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন। পরে ফোন করে দাবি করা হলো ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ। অথচ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে আসে ভয়াবহ এক চক্রের চেহারা, যার অন্যতম সদস্য একজন রাজনৈতিক দলের নেতা!
এই ঘটনায় একদিকে যেমন রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর চোখে পড়েছে, তেমনি প্রশ্ন উঠেছে প্রবাসীদের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও।
১১ জুলাই রাতে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরা সোহেল সরকার সরাসরি শ্বশুরবাড়ি চান্দিনায় যান। ১৪ জুলাই দুপুরে ৫-৬ জন ব্যক্তি তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে নিজেদের সিআইডি পরিচয় দিয়ে তাকে ‘অবৈধ মালামাল’ রাখার অভিযোগে তুলে নিয়ে যায়। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নয়—ছিলো সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র।তারা শুধু সোহেল সরকারকে অপহরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি; তার শ্বশুরবাড়ি থেকে লুট করেছে প্রায় ৯ ভরি স্বর্ণালংকার, একটি আইফোন ও একটি স্মার্ট ফোন। এরপর দাবিকৃত মুক্তিপণের কথা জানিয়ে ফোন করে তার স্ত্রীকে।
সোহেলের স্ত্রী বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে গিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেন। এরপর সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে ওই রাতেই প্রবাসী সোহেল সরকারকে কাঠেরপুল এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে সোহেল মুন্সিসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরদিন রাতে আরও তিনজনকে আটক করে পুলিশ। এদের সবাই মিলে গঠন করেছিল এক আন্তঃজেলা অপহরণ ও ছিনতাইকারী চক্র। পুলিশ অভিযানে লুট হওয়া স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোনও উদ্ধার করেছে।
এই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন চান্দিনা পৌরসভা শ্রমিকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল মুন্সি। তার পরিচয় কেবল একজন দুষ্কৃতিকারী নয়, বরং রাজনৈতিক ব্যানারে বৈধতা পাওয়া একজন অপরাধী হিসেবে উঠে এসেছে। এটি কেবল লজ্জাজনক নয়, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের জন্যও বিপজ্জনক সংকেত।রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এমন অপরাধীদের লালনপালন আজ প্রশ্ন তুলছে—
- স্থানীয় নেতৃত্ব কতটা দায়ী?
- রাজনৈতিক দলগুলো কী ধরনের তদারকি করছে তাদের নেতাকর্মীদের উপর?
এই ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, রাজনৈতিক পরিচয় অনেক সময় অপরাধীদের জন্য একটি ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বিত পদক্ষেপে প্রবাসী উদ্ধার ও আসামি গ্রেপ্তার অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—
- যদি ভুক্তভোগীর স্ত্রী সেনা ক্যাম্পে না যেতেন?
- যদি অপহরণকারীরা দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতেন?
এই ধরনের অপরাধ রোধে আইডি কার্ড যাচাই, বাসায় হানা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভিডিও প্রমাণ বাধ্যতামূলক করা, এবং সুশীল নজরদারি বাড়ানো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রবাসীরা দেশে ফেরার পর যখন সিআইডি পরিচয়ে অপহৃত হন, তখন কেবল একজন ব্যক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হন না— ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি বিশ্বস্ততা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থার ওপর ভর করে দেশে টাকা পাঠায় লাখো প্রবাসী।
সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জোর দাবি, প্রবাসী নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি যেন আরও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
চান্দিনার ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়— এটি একটি প্রতীকী ঘটনা, যা প্রমাণ করে রাজনৈতিক পরিচয়, নিরাপত্তা বাহিনীর ছদ্মবেশ, এবং দুর্বল সামাজিক নজরদারি কতটা ভয়ঙ্কর চক্রের জন্ম দিতে পারে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই আইন সংশোধন, রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

 
                         
         
         
         
         
        