উত্তরা বিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিশু আব্দুল্লাহ ছামীম চিকিৎসা চেয়ে বলেছিল, “মা, আমাকে বিদেশে নিয়ে যাও।” এই মৃত্যু কি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর প্রতিচ্ছবি?
উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাদে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যু হলো এক সম্ভাবনাময় কিশোরের—আব্দুল্লাহ ছামীম। রাজধানীর উত্তরায় স্কুলে বসে থাকা শতশত শিশুর জন্য এটি ছিল দুঃস্বপ্নের মতো মুহূর্ত। কিন্তু আব্দুল্লাহর জন্য এটি হলো জীবনের শেষ দিন। তার শেষ বাক্যে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ও জরুরি সেবা ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি এক অসহায় শিশু নাগরিকের ক্রন্দন।
“মা, হাসপাতাল এত দূরে কেন? আমাকে বিদেশে নিয়ে যাও।”
—এটাই ছিল ১৩ বছরের আব্দুল্লাহ ছামীমের শেষ আর্তনাদ।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এমন দুর্ঘটনায় আহতদের একমাত্র ভরসা ছিল শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউট যা ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে।
যানজট ও সময়ক্ষেপণে অনেকের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়।
প্রশ্ন উঠছে—
উত্তরার মতো ঘনবসতিপূর্ণ আধুনিক এলাকায় কেন নেই একটি পূর্ণাঙ্গ জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র?স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের কি কখনও মনে হয়েছে, বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ রুটের নিচে শিশুদের স্কুল রাখা কতটা নিরাপদ? রাষ্ট্র কি তার শিশু নাগরিকদের জীবন নিয়ে এতটাই উদাসীন?
আব্দুল্লাহ ছিল শরীয়তপুরের মৃত আবুল কালাম মাঝির সন্তান।
বাবার মৃত্যুর শোক সইতে না সইতেই সে নিজেই চলে গেল চিরতরে।
চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার।
বাবা সৌদি আরব থেকে যে স্বপ্ন বুনেছিলেন, তা এদেশের অনিরাপদ আকাশপথ ও দুর্বল মেডিকেল ইমার্জেন্সি ব্যবস্থার কাছে থেমে গেল।
তার শেষ আর্তনাদ ছিল চিকিৎসা চেয়ে, প্রাণ বাঁচানোর আকুতি করে—“মা, আমাকে বিদেশে নিয়ে যাও।”
এই আহাজারি কেবল আব্দুল্লাহর নয়, এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের হাজারো শিশু ও পরিবারের আকুতি, যারা প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার হচ্ছে।
এই দুর্ঘটনার ন্যায্য তদন্তের পাশাপাশি জরুরি করণীয় হচ্ছে উত্তরায় অবিলম্বে একটি আধুনিক বার্ন ইউনিটসহ হাসপাতাল স্থাপন, বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ এলাকা জনবসতি থেকে দূরে সরানো এবং স্কুল-কলেজের নিকটস্থ এলাকায় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা।
তদন্ত কমিটি গঠনই যথেষ্ট নয়, ফলাফল ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
আব্দুল্লাহর মতো আর কোনো শিশুর মৃত্যু যেন এই রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তায় না হয়।
আব্দুল্লাহর মামা, সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম বলেছেন,
“তার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।”
এক আত্মীয়ের শোককে কেবল পারিবারিক বেদনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে—এটি আসলে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে একটি আবেদন।
আব্দুল্লাহ ছামীম চলে গেছে।
তার সঙ্গে চলে গেছে একটি পরিবারের শেষ আশাও।
কিন্তু তার রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলো আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিক বোধের কাছে রয়ে গেল—“হাসপাতাল এত দূরে কেন?” আমরা কি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব?
