 
                  খুলনার ফুলতলায় ইসলামী ব্যাংকের ভেতরে শিক্ষক সাইফুল্লাহ হাজেরীকে হাতুড়ি ও প্লায়ার্স দিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এজেন্ট ব্যাংক কেলেঙ্কারিকে ঘিরে এই নির্যাতন কি শুধুই টাকা ফেরত আদায়ের চেষ্টা, নাকি এটি মানবাধিকারের জঘন্য লঙ্ঘন? পড়ুন বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এমন ভয়ংকর ঘটনা খুব কমই শোনা গেছে—যেখানে একজন গ্রাহক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একটি ব্যাংকের ভিতরে চোখ ও মুখ বেঁধে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয় এবং প্লায়ার্স দিয়ে পায়ের নখ তোলার চেষ্টা করা হয়। খুলনার ইসলামী ব্যাংক ফুলতলা শাখায় এজেন্ট ব্যাংক সংক্রান্ত আর্থিক কেলেঙ্কারিকে ঘিরে ঘটেছে এই নজিরবিহীন নির্যাতনের ঘটনা। ভুক্তভোগী স্কুলশিক্ষক সাইফুল্লাহ হাজেরী বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি ইসলামী ব্যাংকের অনুমোদিত এজেন্ট ব্যাংকের মালিকের ছেলে।
প্রথমে বিষয়টি এক নজরে এজেন্ট ব্যাংকের আর্থিক দুর্নীতি মনে হলেও, বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
এটি একটি ভয়ংকর প্রতিষ্ঠানিক সহিংসতা, যেখানে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিচার ও শাস্তির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন।
জানা গেছে, মাহবুবুর রহমান ও মনিরুল গাজী নামে দুই কর্মচারী প্রায় ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে এজেন্ট ব্যাংক থেকে পালিয়ে যান।
এর জেরে ব্যাংকের কেন্দ্র থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তবে শাস্তি পেয়েছেন মূল অভিযুক্তরা নয়, বরং পেয়েছেন তাদের নিয়োগদাতা হাজেরী এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি সাইফুল্লাহ।
নির্যাতনের আগে তাঁর কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক, স্ট্যাম্প ও সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
আইনগতভাবে এটিকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের শামিল ধরা যায়, যা বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ও মানবাধিকার সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, সাইফুল্লাহকে ডেকে নেওয়ার পর ব্যাংকের স্টোররুমে নিয়ে গিয়ে তার চোখ ও মুখ বেঁধে ৪-৫ জন কর্মকর্তা গণপিটুনি দেন।
এর মাধ্যমে ব্যাংকের ভেতরেই যেন একটি ‘বেসরকারি কারাগার’ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে আইন, সংবিধান ও মানবিকতা নিষিদ্ধ।
এই ঘটনা কেবল এক ব্যক্তির ওপর নির্যাতন নয়, বরং পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর চরম আঘাত।
এই ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর হস্তক্ষেপ জরুরি ছিল।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এর ভেতরে এমন অমানবিক নির্যাতন প্রমাণ করে—ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি তলানিতে পৌঁছেছে।
সাইফুল্লাহর পরিবারের ভাষ্যমতে,
ব্যাংকের কর্মকর্তারা এখন ভুল স্বীকার করে উন্নত চিকিৎসার প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে কি?
ফুলতলা থানা-পুলিশ ইতোমধ্যে তিন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
মামলা হয়েছে সাইফুল্লাহর মামার মাধ্যমে।
তবে ঘটনা সংঘটনের স্থান যেহেতু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রকে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।
এটি নিছক মামলা বা গ্রেপ্তারে সীমাবদ্ধ রাখলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইসলামী ব্যাংকের ফুলতলা শাখায় সাইফুল্লাহ হাজেরীর ওপর এই পৈশাচিক নির্যাতন কেবল একটি ব্যাংকিং সমস্যা নয়, এটি ব্যবস্থাগত সহিংসতার নগ্ন প্রকাশ।
গ্রাহকের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন—সবকিছুরই পরিপন্থী এই ঘটনা রাষ্ট্র ও সমাজকে গভীর আত্মসমালোচনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যদি এই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুনে স্বচ্ছতা না আসে, তবে ভবিষ্যতে যেকোনো গ্রাহকও ব্যাংকের ভেতর এমন নির্যাতনের শিকার হতে পারেন।
এই অবস্থায় ব্যাংকের আস্থা পুনরুদ্ধার শুধু কথায় নয়, আইনি ও নৈতিক ব্যবস্থায়ই সম্ভব।

 
                         
         
         
         
         
         
        