চানখাঁরপুলে ৬ হত্যা মামলার সাক্ষ্যে উঠে এসেছে ‘হিন্দিভাষী’ পুলিশের কথা। তদন্তে দেখা যাচ্ছে, এরা ভারতীয় নয়, বরং পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন বা আইএসআই রিক্রুট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই বিশ্লেষণে উন্মোচিত হয়েছে পুরো ষড়যন্ত্রের পটভূমি।

চানখাঁরপুলে ৬ হত্যা মামলার এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি বলেছেন— হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনেছেন। প্রথম শুনলে এটি ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দেয়, বিশেষ করে জুলাই ষড়যন্ত্রের সময় ছড়ানো গুজবের পটভূমিতে। তখন নানা প্রচার ছিল— ভারতীয় সৈন্য ও পুলিশ বাংলাদেশে ঢুকেছে, আন্দোলন দমন করছে, ছাত্রদের হত্যা করছে।
কিন্তু গত এক বছরে, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর, ইউনূস সরকার কি একজনও ভারতীয় পুলিশ বা সৈন্য গ্রেপ্তার করতে পেরেছে?
উত্তর— না।
এমনকি শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে সময় লেগেছে মাত্র ৪৫ মিনিট; যদি সত্যিই ভারতীয় বাহিনী এখানে থাকত, তারা রাতারাতি জিনের মতো উধাও হতে পারত না।
সুতরাং এ প্রমাণ স্পষ্ট যে, “ভারতীয় পুলিশ” গল্পটি ছিল পরিকল্পিত গুজব।
এখানে মূল প্রশ্ন— সাক্ষী আসলে কী শুনেছেন?
আমরা হিন্দি ছবির মাধ্যমে হিন্দি চিনতে পারলেও কথ্য হিন্দি ও উর্দুর পার্থক্য সাধারণ বাঙালির জন্য ধরা কঠিন, বিশেষত সংঘর্ষের বিশৃঙ্খল পরিবেশে।
ভাষাগত মিলের কারণে সাক্ষী যা “হিন্দি” বলেছেন, তা আসলে “উর্দু” হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
জুলাই ষড়যন্ত্রের অন্যতম বড় স্টেকহোল্ডার ছিল পাকিস্তান— এটি এখন আর গোপন নয়।
৫ আগস্টের পর পাকিস্তান দূতাবাস ও সেনা-জামায়াত-ইউনূস ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ প্রকাশ্যে এসেছে।
ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পাকিস্তানি নাগরিকের উপস্থিতিও সম্প্রতি ধরা পড়েছে।
এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বহুদিন ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সক্রিয়।
তাদের পছন্দের হাতিয়ার— লস্কর-ই-তৈয়াবার মতো জঙ্গি সংগঠন, যারা ছদ্মবেশে অভিযান চালাতে অভ্যস্ত।
পুলিশের পোশাক বা সাংবাদিক ভেস্ট পরে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো তাদের পরিচিত কৌশল।
১৯৭১ এ পাকিস্তানি সেনার সহযোগী হিসেবে উর্দুভাষী বিহারীদের ভূমিকা সুপরিচিত।
১৯৯০-এর দশক: লস্কর-ই-তৈয়াবা, হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামি (হুজি-বি) এবং অন্যান্য পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে ঘাঁটি গড়ে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পেছনে আইএসআই ও পাকিস্তানি জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
২০২৪ এর জুলাই ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান দূতাবাসের অস্বাভাবিক সক্রিয়তা, সেনা-জামায়াত-ইউনূস ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ এবং ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পাকিস্তানি নাগরিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে।
উর্দুভাষী আরেকটি সম্ভাব্য গোষ্ঠী হলো বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারীরা, যাদের ইতিহাস ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনার সহযোগিতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
২০২৪ সালেও তাদের বড় একটি অংশ ইউনূস সরকারের পক্ষে ছিল।
তবে বিশ্লেষণ বলছে—
বিহারীরা সাধারণত দেশীয় অস্ত্রে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, যেখানে চানখাঁরপুল ঘটনার মতো আগ্নেয়াস্ত্র-ভিত্তিক, ফিল্ড-অপারেশন কৌশল প্রশিক্ষিত মিলিট্যান্টদের কাজের ইঙ্গিত দেয়।
গত এক বছরে একজনও ভারতীয় পুলিশ বা সৈন্য ধরা পড়েনি।
উর্দু বলা লোকজন পাকিস্তানি বা উর্দুভাষী বিহারী হতে পারে, কিন্তু অস্ত্র ব্যবহারের ধরন প্রশিক্ষিত সংগঠনের নির্দেশ দেয়।
লস্কর-ই-তৈয়াবা ও অন্যান্য পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন পুলিশ ছদ্মবেশের কৌশল বহুবার ব্যবহার করেছে।
জুলাই ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের ভূমিকায় প্রচুর প্রমাণ ইতিমধ্যেই বিদ্যমান।
হিন্দিভাষী পুলিশের ঘটনা ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির প্রমাণ নয়— বরং পাকিস্তানি মিলিট্যান্ট নেটওয়ার্কের ছায়া আরও ঘন করে তোলে।
ভাষার বিভ্রান্তি, গুজবের প্রচার এবং রাজনৈতিক স্বার্থ মিলিয়ে একটি সুপরিকল্পিত অপারেশন চালানো হয়েছিল।
সত্য এখনো পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু প্রমাণের ধারাবাহিকতা স্পষ্ট করে— এই হিন্দি আসলে উর্দু, আর এর পেছনে পাকিস্তানি জঙ্গিদের হাত থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।

 
                         
         
         
        