৫ আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনার দেশত্যাগের প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, স্বজনপ্রীতি ও বেইমান বাছাইয়ের মাশুল নিয়ে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে ৫ আগস্ট ২০২৪ এক বিভীষিকাময় দিন। সাংবাদিক নবনীতা চৌধুরীর তথ্য অনুযায়ী, ওইদিন সকাল ১১টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান উত্তরার প্রবেশমুখ খুলে দিয়ে জুলাই সন্ত্রাসীদের ঢাকায় প্রবেশের সুযোগ করে দেন। ঠিক এরপরই শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় এসএসএফ ও প্রেসিডেন্ট রেজিমেন্ট গার্ড এবং তাদের উদ্যোগেই শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন।
প্রশ্ন হলো—এই ঘটনার পরও শেখ হাসিনার কি ওয়াকারের উপর ভরসা রাখা উচিত ছিল?
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: সেনাবাহিনী ও বিশ্বাসঘাতকতা
বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কখনোই নিরপেক্ষ বা নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি।
- ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে সেনাবাহিনী দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গাদ্দারি করে।
- ২০০৭ সালে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সেনাবাহিনী সরাসরি ভূমিকা নেয়।
- ২০২৪ সালে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও দ্বিধাগ্রস্ত ভূমিকা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে।
তাহলে শেখ হাসিনা কেনই বা সেনাপ্রধান ওয়াকারের উপর নির্ভর করবেন? ইতিহাস প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কখনো রাষ্ট্রপ্রধানকে বহিঃশত্রু থেকে রক্ষা করতে পারেনি; বরং বারবার অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের অংশ হয়েছে।
ওয়াকার নিয়োগের পেছনে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ
শেখ হাসিনা যখন ওয়াকারকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেন, তখনই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা আপত্তি তোলে তার রাজনৈতিক ঝোঁকের কারণে।
বিশেষত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সরাসরি প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব উপেক্ষা করেন—
- কারণ ওয়াকার তাঁর ফুফাতো বোন সারাহনাজ কমলিকার স্বামী,
- এবং তাঁর প্রথম সরকারের সেনাপ্রধান জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানের জামাতা।
এটাই শেখ হাসিনার স্বজনপ্রীতির রাজনৈতিক দুর্বলতা। তিনি বারবার আত্মীয়, আত্মীয়ের সন্তান বা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গীদের অযোগ্য উত্তরসূরিদের গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন সোহেল তাজ—যিনি অযোগ্যতা ও অস্থিরতার কারণে রাজনীতি ছেড়ে পালিয়ে যান, কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁকে বহুবার ফের সুযোগ দিতে চেয়েছেন।
বেইমান বাছাইয়ের মাশুল
ইতিহাস সাক্ষী—শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা উভয়েই অতিরিক্ত বিশ্বাস ও বেইমান বাছাইয়ের মাশুল দিয়েছেন। ওয়াকারের প্রথম সাক্ষাৎকারেই আসিফ নজরুল ও জামায়াত নেতাদের প্রতি তার পক্ষপাত স্পষ্ট হয়ে যায়।
- তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার মতো সিদ্ধান্তে নীরব থেকেছেন।
- ইউনুস, পঞ্চতাণ্ডব কিংবা জুলাই মাস্টারমাইন্ডদের মোকাবেলায় কোন দৃঢ় অবস্থান নেননি।
- গোপালগঞ্জে গিয়ে জনতার কাছে গণধোলাই খেয়ে আসা তার অজনপ্রিয়তা স্পষ্ট করেছে।
একজন সেনাপ্রধানের কাছ থেকে যে দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম আশা করা হয়, ওয়াকার সেখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।
আগামী দিনের শিক্ষা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি আবার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে, তবে বাছাই প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতেই হবে। আত্মীয় বা পারিবারিক সম্পর্ক নয়, কেবল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাষ্ট্রের প্রতি অবিচল আনুগত্যকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
কারণ, সস্তা বেইমানদের কারণে দেশ একের পর এক ষড়যন্ত্রে জর্জরিত হয়েছে। আর এই ব্যর্থতার দায় কেবল প্রতিপক্ষ নয়, বরং আগের সরকারকেই নিতে হবে।
শেষকথা
৫ আগস্টের ঘটনার পর প্রশ্ন জাগছে—সেনাবাহিনীর উপর ভরসা রাখা কতটা যৌক্তিক? শেখ হাসিনা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েও বারবার স্বজনপ্রীতি ও অযোগ্য বাছাইয়ের কারণে দেশ ও নিজেকে বিপদে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে যদি নতুন বাংলাদেশ গড়তে হয়, তবে বেইমান ও সুযোগসন্ধানীদের ছেঁকে ফেলে কেবল অনুগত, দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষদের দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
