 
                  বদরুদ্দীন উমর কেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুয়া বলেন? তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, পিতা আবুল হাশেমের রাজনৈতিক ভূমিকা এবং জমিদার শ্রেণির মানসিকতার বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা সময়ে বিতর্কিত অবস্থান নিয়েছেন বদরুদ্দীন উমর। তার লেখালেখিতে প্রায়ই উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধকে “বেহাত হয়ে যাওয়া” বা “ভুয়া ইতিহাস” হিসেবে চিত্রিত করার প্রবণতা। কেন তিনি এমনটা ভাবেন, সেটি বোঝার জন্য তার পারিবারিক শেকড় এবং রাজনৈতিক পটভূমি জানা জরুরি।
বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশেম ছিলেন ব্রিটিশ আমলের প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের সন্তান।
তাদের পরিবার ছিল বর্ধমান জেলার কাশিয়ারার জমিদার, যারা ব্রিটিশ শাসকদের সহযোগী হিসেবে নানান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন।
নওয়াব উপাধি, জমিদারি—সবই ছিল গরীব কৃষকের ঘামে-রক্তে টিকে থাকা এই অভিজাত শ্রেণির প্রাপ্তি।
এক কথায়, তারা ছিলেন বাংলার খেটে-খাওয়া মানুষের ওপর চাপানো আধিপত্যের অংশ।
আবুল হাশেম মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে ১৯৪৩ সালে বাংলার সাধারণ সম্পাদক হন।
জিন্নাহর কিছু সমালোচক হলেও দেশভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এসে পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন।
বিশেষত, তিনি কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন, যা পাকিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করেছিল।
এখানেই দেখা যায়, পাকিস্তানি রাষ্ট্রবাদ এবং ইসলামি আদর্শিক কাঠামোর সঙ্গে আবুল হাশেমের গভীর সম্পৃক্ততা।
এই পরিবার পাকিস্তানকেন্দ্রিক ভাবনায় যতটা নিবেদিত, ততটাই বিমুখ ছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলন থেকে।
শেখ মুজিব ছিলেন সাধারণ কৃষক-কেরানির পরিবারের সন্তান।
নিজের মেধা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বগুণে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা।
বিপরীতে, বদরুদ্দীন উমরদের মতো অভিজাত পরিবারগুলোর কাছে এটি ছিল এক অপমানজনক বাস্তবতা—একজন চাষার সন্তান তাদের ঐতিহ্য ও আধিপত্যকে ভেঙে দিল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন দেশের কোটি কোটি মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত, শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
অথচ ঢাকায় বদরুদ্দীন উমর ছিলেন নিরাপদ।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি ধারাবাহিকভাবে লেখালেখি করেন—কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হলো, কিভাবে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের অর্জন নষ্ট করে দিল।
এখানেই স্পষ্ট হয়, বদরুদ্দীন উমরের মুক্তিযুদ্ধকে ভুয়া বলার পেছনে দুটি মূল প্রেক্ষাপট কাজ করেছে—
পারিবারিক উত্তরাধিকার: পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের সঙ্গে তাদের পারিবারিক শিকড়।
শ্রেণিগত অহংকার: জমিদার পরিবারের সন্তান হয়ে সাধারণ কৃষকের সন্তান শেখ মুজিবের কাছে পরাজয় মেনে নিতে না পারা।
তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া এবং নিজেদের এলিট আধিপত্যের সমাপ্তি।
তাই মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের বিজয় নয়, বরং নিজেদের পরাজয়ের ইতিহাস হিসেবে দেখেছেন তারা।
বদরুদ্দীন উমরদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ “ভুয়া” ইতিহাস—কিন্তু বাস্তবে তা ছিল বঞ্চিত বাংলার কৃষক, মজুর, শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতা।
শেখ মুজিবের সেই তর্জনি শুধু একজন নেতার প্রতীক ছিল না, বরং বাংলার শোষিত মানুষের বিদ্রোহী গর্জন ছিল।
আর সেই গর্জনই অভিজাত পরিবারগুলোর অহংকার ভেঙে দিয়েছিল।

 
                         
         
         
        