ওয়াসার এমডি নিয়োগে কোটি টাকার দরদামের অভিযোগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সুনামকে গরুর বাজারে নামিয়ে এনেছে। দুর্নীতি ঠেকাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এখন জরুরি।
ঢাকা ওয়াসা—দেশের অন্যতম কৌশলগত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত এই সংস্থার প্রধান দায়িত্ব হলো পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু এই মৌলিক জনসেবার প্রতিষ্ঠানটি আজকে আলোচনায় এসেছে এক ভয়ঙ্কর অভিযোগের কারণে—ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগকে ঘিরে কোটি টাকার দরদামের হাট বসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম ব্যাপারী এমডি পদ পাওয়ার জন্য সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ মহলে ১০০ কোটি টাকার অফার দিয়েছেন।
অন্যদিকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত মাহমুদ পাল্টা অফার দিয়েছেন আরও বড় অঙ্ক—১৫০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন উঠছে—রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের এমডি পদ কি এখন নিলামে বিক্রি হচ্ছে?
ওয়াসার এমডি পদকে ঘিরে অস্বাভাবিক দরদামের পেছনে রয়েছে কয়েকটি সুস্পষ্ট কারণ:
প্রতিদিনের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব প্রবাহ — পানির বিল, সংযোগ ফি, বাণিজ্যিক সরবরাহ ইত্যাদি থেকে যে বিশাল অঙ্ক আসে, তা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ।
প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে কমিশন সিন্ডিকেট — বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার কমিশন ঘুরে বেড়ায়।
বিদেশি ঋণ ও কন্ট্রাক্ট বণ্টনের নিয়ন্ত্রণ — উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ ও সহায়তার নামে গড়ে ওঠা আরেকটি অর্থনৈতিক সিন্ডিকেট।
অতএব, যে এই পদে বসবে, তার হাতে থাকবে বিপুল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ।
ফলে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের কাছে এটি শুধু একটি চাকরি নয়—বরং কোটি টাকার বিনিয়োগের “রিটার্ন পাওয়ার মেশিন।”
ঢাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছে নোংরা পানি, পানি সংকট, অতিরিক্ত বিল এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার যন্ত্রণা নিয়ে।
এখন যদি ওয়াসার এমডি পদ কোটি টাকায় কেনাবেচা হয়, তবে কর্মকর্তা-পরিচালকদের প্রথম কাজ হবে জনগণের সমস্যা সমাধান নয়, বরং “তোলা টাকা উদ্ধার”।
এতে তিনটি বড় বিপদ তৈরি হবে—
পানি সরবরাহ আরও সংকটে পড়বে।
প্রকল্প হবে জনকল্যাণ নয়, কমিশন নির্ভর।
সেবা পাওয়া নাগরিকের অধিকার আরও খর্ব হবে।
অর্থাৎ, ওয়াসাকে একটি স্বচ্ছ সেবাধর্মী সংস্থা থেকে পুরোপুরি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
এমডি নিয়োগ নিয়ে দরদামের এই সংস্কৃতি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্য একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে যদি গরুর হাটের মতো দরদামের টেবিলে বসানো হয়, তবে এর পরিণতি হবে—
সেবার মান শূন্যে নেমে আসবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে।
দুর্নীতির সংস্কৃতি আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে।
ওয়াসাকে বাঁচাতে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
এমডি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
প্রার্থীদের সম্পদ ও অর্থের উৎসের বিচার-বিশ্লেষণ করা।
দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা।
ওয়াসার মতো কৌশলগত প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিন্ডিকেটের হাত থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা দেওয়া।
ওয়াসা শুধু একটি সংস্থা নয়, বরং রাজধানীর কোটি মানুষের জীবনরক্ষার অবলম্বন।
এমডি পদে দরদামের হাট বসানো শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নয়—এটি সমগ্র প্রশাসনিক নৈতিকতার অবমাননা।
সরকার যদি এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে এর খেসারত দেবে সাধারণ মানুষ—নোংরা পানি, পানি সংকট এবং দুর্নীতির দুষ্টচক্রের যন্ত্রণায়।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে গরুর বাজারে রূপান্তর করার এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে এখনই।
অন্যথায় জনগণের আস্থা ও রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা—দুটোই ধ্বংস হয়ে যাবে।
