ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন দাবি করেছেন, জুলাই আন্দোলনে নিহতরা ছিলেন প্রফেশনাল স্নাইপার হামলার শিকার। প্রশ্ন উঠছে—বিদেশি প্রশিক্ষিত কিলাররা কি শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ঢাকায় এসেছিল?
১৯ আগস্ট (২০২৫) এক সামরিক কর্মকর্তাদের প্রোগ্রামে বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এক বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, গত বছরের জুলাই আন্দোলনে নিহত প্রায় সবাই মাথায় গুলি খেয়ে মারা গেছেন, আর আহতদের মধ্যে যারা চোখ হারিয়েছেন, তারাও ছিলেন স্নাইপার টার্গেটের শিকার।
সাখাওয়াত হোসেনের ভাষায়— “পুরো জুলাই আন্দোলনজুড়ে প্রফেশনাল স্নাইপার অ্যাটাক হয়েছে। এটা পুলিশের কাজ নয়, বাংলাদেশের পুলিশের স্নাইপার রাইফেল প্রশিক্ষণই নেই।”
শুধু তাই নয়, তিনি আরও এক ভয়াবহ ঘটনা বর্ণনা করেন।
আন্দোলনের সময় মহাখালীর শাহীন কমপ্লেক্সে পৌঁছালে হঠাৎ সেনা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তার ফোনে সতর্কবার্তা আসে।
“স্যার, আপনি স্নাইপারদের টার্গেট এরিয়ায় ঢুকে পড়েছেন, দ্রুত এলাকা ত্যাগ করুন।” অর্থাৎ, সেনা গোয়েন্দারা জানতো ঢাকার কোথায় কোথায় স্নাইপাররা পজিশন নিয়েছিল।
এর মানে, দেশের ভেতরেই ছিল এমন এক অদৃশ্য নেটওয়ার্ক, যারা আন্দোলনের আড়ালে প্রফেশনাল কিলার হিসেবে কাজ করছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলনে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি চালনার ঘটনা নতুন নয়।
কিন্তু সাধারণ পুলিশের হাতে যে অস্ত্র থাকে, তা মূলত শটগান, রাইফেল বা রাবার বুলেট লোডেড বন্দুক। পুলিশ সদস্যদের স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার ও টার্গেট শ্যুটিংয়ের প্রশিক্ষণ নেই।
জুলাই আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নিহতদের অধিকাংশই মাথা ও চোখে গুলি খেয়েছেন।
এটি সাধারণত হাই-প্রিসিশন শ্যুটিংয়ের মাধ্যমে করা হয়, যা কেবল প্রশিক্ষিত স্নাইপারের পক্ষেই সম্ভব।
সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে—বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা লিবিয়ার ২০১১ সালের গাদ্দাফি বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
লিবিয়ার আন্দোলনের সময় জানা যায়, ফ্রান্স গোপনে কয়েকশ লিবীয় তরুণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
এর মধ্যে প্রায় ২০০+ জনকে স্নাইপার রাইফেল ব্যবহারের স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া হয়।
আন্দোলন শুরু হলে তারা সাধারণ মানুষের ভেতর মিশে গিয়ে রাস্তায় নামেন। গাদ্দাফির পতনে বিদেশি স্নাইপার টিম ও প্রশিক্ষিত তরুণরা বড় ভূমিকা রাখে।
প্রশ্ন হচ্ছে,
বাংলাদেশে কি একই ধরনের পরিকল্পনা আগে থেকেই সাজানো হয়েছিল? বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা কি তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল?
তারা কি আন্দোলনের সময় সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে স্নাইপার হিসেবে কাজ করেছে? তাদের লক্ষ্য কি কেবল সরকার উৎখাত নয়, বরং শেখ হাসিনাকে সরাসরি হত্যার ষড়যন্ত্রও ছিল?
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নতুন নয়।
কিন্তু স্নাইপার আক্রমণের প্রসঙ্গ তুললে এটি কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এটি সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রকে অচল করার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়।
যদি সত্যি ঢাকার রাস্তায় বিদেশি স্নাইপাররা সক্রিয় ছিল, তাহলে প্রশ্ন জাগে—
তাদের লক্ষ্যবস্তু কারা ছিল?
সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আন্দোলনকে আন্তর্জাতিকভাবে “রাষ্ট্রীয় গণহত্যা” হিসেবে প্রচার করা? নাকি শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে দেশের নেতৃত্ব শূন্য করার পরিকল্পনা?
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও নিরাপত্তা–বেষ্টিত দেশে শত শত বা হাজারো স্নাইপার রাইফেল ঢোকানো সহজ নয়। তবু যদি ঢুকে থাকে, তাহলে সম্ভাব্য পথগুলো কী?
বাংলাদেশে অসংখ্য গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয়—ডিজিএফআই, এনএসআই, র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট, পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি।
তবু যদি স্নাইপার টিম ঢাকায় অবস্থান করতে পারে, তাহলে তিনটি প্রশ্ন ওঠে—
গোয়েন্দারা কি আগেই জানত, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে চুপ থেকেছে? না কি বিদেশি শক্তির চাপ ও চক্রান্তে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল? নাকি গোয়েন্দা সংস্থার ভেতর থেকেই কারও সহযোগিতা ছিল?
সাখাওয়াত হোসেনের স্বীকারোক্তি— “গোয়েন্দারা জানতো কোথায় কোথায় স্নাইপাররা আছে” এবং এটা প্রমাণ করে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন, সেটাই এখন বড় রহস্য।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের করিডোর, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, চট্টগ্রাম বন্দর—সবই আন্তর্জাতিক শক্তির নজরে।
ইতিহাস বলে, যেসব দেশে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে, সেখানে রাজনৈতিক আন্দোলনকে অনেক সময় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা সামরিক রূপ দেয়। লিবিয়ার মত বাংলাদেশেও কি সেই একই ছক কাটা হয়েছে?
আন্দোলনের নামে বিদেশি প্রশিক্ষিত স্নাইপার ব্যবহার, মানুষকে হত্যা করে সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে অচল করা, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করা এবং অবশেষে বিদেশি স্বার্থের অনুগত সরকার চাপিয়ে দেয়া
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্য নিছক বিতর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা।
জুলাই আন্দোলন যদি সত্যিই বিদেশি স্নাইপার নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব গভীর সংকটে।
শেখ হাসিনা কেবল রাজনৈতিক বিরোধিতার টার্গেট নন, বরং আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিরও কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন।
