 
                  বাংলাদেশের নদীতে প্রতিমাসে গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে, যার প্রায় ৩০ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। কেন নদী এখন গুমের ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের ব্যর্থতা কোথায়—পড়ুন বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের নদীগুলো দীর্ঘকাল ধরে জীবন, অর্থনীতি ও সভ্যতার উৎস হলেও আজ সেগুলো এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। প্রতিমাসে গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধারের সাম্প্রতিক নৌ পুলিশ পরিসংখ্যান আমাদের সামনে যে চিত্র হাজির করেছে, তা কেবল আইনশৃঙ্খলার সংকট নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নজরদারির শূন্যতাকেও স্পষ্ট করে তোলে। ২০২৪ সালে ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল নদী থেকে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০১।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এর প্রায় ৩০ শতাংশ মরদেহের পরিচয়ই আজও শনাক্ত হয়নি।
অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক যথার্থই বলেছেন—নদীতে মরদেহ ফেললে তা শনাক্ত করা কঠিন।
পচন, বিকৃত চেহারা এবং আঙুলের ছাপ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মরদেহ শনাক্ত সম্ভব হয় না।
অপরাধীরা এই দুর্বলতাকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা কিংবা পদ্মার বিভিন্ন অংশে নিয়মিত এ ধরনের লাশ উদ্ধার প্রমাণ করে—নদী এখন “গোপন গুমের ডাম্পিং স্টেশন” হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঢাকা অঞ্চলের নৌ পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বীকার করেছেন, জনবল ও লজিস্টিক সংকটের কারণে মরদেহ উদ্ধার ও শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
একদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও নগর অপরাধ, অন্যদিকে সীমিত প্রযুক্তি ও বাজেট—এই দ্বৈত সংকটে নৌ পুলিশ কার্যকর তদন্তে হিমশিম খাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো— রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার এমন গুরুতর ব্যর্থতার দায় কেবল পুলিশ বিভাগের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কতটা ন্যায়সঙ্গত?
নদী থেকে পাওয়া মরদেহ কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান নয়; এটি আমাদের আইনি, সামাজিক ও মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।
অশনাক্ত মরদেহ মানে একেকটি পরিবার আজও জানে না তাদের প্রিয়জন কোথায় হারিয়ে গেছে।
অশনাক্ত মরদেহের সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে গুম ও অজ্ঞাত হত্যার অন্ধকার রাজনীতি।
নদীপথে সিসিটিভি নজরদারি ও আধুনিক ফরেনসিক প্রযুক্তি ব্যবহার অপরিহার্য।
নৌ পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অশনাক্ত মরদেহের ডিএনএ ডাটাবেস তৈরি করে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে মেলানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো; অপরাধপ্রবণ অঞ্চলগুলোকে “রেড জোন” ঘোষণা করে সেখানে বিশেষ টাস্কফোর্স নিয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশের নদীগুলো আমাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির অংশ হলেও অপরাধীরা এখন সেগুলোকে গোপন কবরস্থানে পরিণত করছে।
প্রতিমাসে গড়ে ৪৩টি লাশ ভেসে ওঠা কেবল পরিসংখ্যান নয়—এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও সমাজের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা।
এ সংকট সমাধান না হলে অশনাক্ত মরদেহের সংখ্যা শুধু বাড়বেই, আর প্রতিটি অশনাক্ত মরদেহই হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার প্রতীক।

 
                         
         
         
        