১৯৮০ সালে জিয়া-ইন্দিরা বৈঠককে ঘিরে “গোপন চুক্তি”র বিতর্ক আজও রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিধ্বনিত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—আওয়ামী লীগ নয়, বরং জিয়াউর রহমানই ভারতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ক্ষমতা রক্ষার জন্য। তাহলে “ভারতের দালাল” আসলেই কারা?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ভারতের দালাল” শব্দবন্ধটি বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। বর্তমানে বিএনপি আওয়ামী লীগকে এ অভিযোগে আক্রমণ করলেও ইতিহাসের দলিল উল্টো এক বাস্তবতা সামনে আনে। ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেন। বৈঠকের পরপরই বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় শিরোনাম— “জিয়া–ইন্দিরা গোপন চুক্তি?”।
এই শিরোনামই আজকের রাজনীতিতে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে—ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কারা গোপনে করেছিল, আর কারা প্রকাশ্যে?
সাংবাদিক মানস ঘোষসহ একাধিক বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন, জিয়ার দিল্লি সফরের উদ্দেশ্য ছিল মূলত রাজনৈতিক টিকে থাকা।
তার কৌশলগত লক্ষ্য ছিল তিনটি:
ভারতের আস্থা অর্জন: পাকিস্তান ও চীনের ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি ভারতের সায় ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা কঠিন ছিল।
আওয়ামী লীগ দমন: সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগপন্থী আন্দোলন দমনে ভারতের নীরব সমর্থন পাওয়া।
দ্বিপাক্ষিক ইস্যু: গঙ্গার পানি, সীমান্ত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আলোচনায় এলো বটে, কিন্তু মূল ফোকাস ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা।
১৯৮০ সালের বৈঠকের পর রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে—জিয়া ভারতের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় গিয়েছিলেন।
অভিযোগ ছিল, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে তিনি ভারতের সমর্থন চাইছিলেন।
এই প্রেক্ষাপটেই আজকের বাস্তবতা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কারণ বিএনপি এখনো আওয়ামী লীগকে “ভারতের দালাল” আখ্যা দিয়ে প্রচার চালালেও, দলের প্রতিষ্ঠাতাই ভারতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা শেখ হাসিনার সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবসময় ছিল খোলামেলা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে।
- বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইন্দিরার চোখে চোখ রেখে ন্যায্য দাবি আদায় করেছিলেন।
- শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে পানি, সীমান্ত, নিরাপত্তা ও বাণিজ্য ইস্যুতে যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।
- আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে “গোপন দরকষাকষি”র ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
আজকের দিনে বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগকে ভারতের দালাল বলে আক্রমণ করেন।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ক্ষমতা রক্ষার প্রয়াসে ভারতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান নিজেই।
তাহলে প্রশ্ন হলো—
ভারতের দালাল কারা?
যারা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক স্বার্থে সম্পর্ক রক্ষা করে, নাকি যারা গোপনে দর কষাকষি করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চায়?
ইতিহাসের পুরনো দলিল ও সংবাদপত্রের কাটিং আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়— রাজনৈতিক প্রচারণা যতই চেষ্টা করুক, সত্যকে আড়াল করা যায় না।
জিয়া-ইন্দিরা বৈঠকের আড়ালের ইতিহাস তাই শুধু অতীত নয়, বরং বর্তমান রাজনীতিতেও প্রতিধ্বনিত হয়।
