ঢাকার ওয়েস্টিন হোটেলে মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ডের কর্মকর্তা টেরেন্স আরভেল জ্যাকসনের আকস্মিক মৃত্যু ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ সরিয়ে নেওয়া, কভার আইডেনটিটি ও রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা বিষয়টিকে আরও সন্দেহজনক করে তুলেছে।
৩১ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ঢাকার অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলের ৮০৮ নম্বর কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় টেরেন্স আরভেল জ্যাকসন নামের এক মার্কিন নাগরিককে। কাগজে-কলমে তিনি ছিলেন একজন “ব্যবসায়ী”, কিন্তু আসল পরিচয় ছিল ভিন্ন—তিনি ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর ১ম স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ড (এয়ারবর্ন) এর কমান্ড ইন্সপেক্টর জেনারেল, একজন গ্রিন বেরেটস অফিসার।
হোটেল কর্মীদের বর্ণনা অনুযায়ী, জ্যাকসন ছিলেন সুস্থ-সবল ও দেখতে ফিট। অথচ হঠাৎ করেই মৃত্যু ঘটে। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন তুলেছে মার্কিন দূতাবাসের অস্বাভাবিক আচরণ—ময়নাতদন্ত ছাড়াই দ্রুত লাশ সরিয়ে ফেলা হয়, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ রেখেই।
টেরেন্স আরভেল জ্যাকসনের পেশাগত প্রোফাইল তাকে নিছক কোনো “ব্যবসায়ী” হিসেবে মানতে দেয় না:
- বিশেষায়ন: অনকনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার, সাইকোলজিক্যাল অপারেশন, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান।
- দক্ষতা: বিদেশি সেনাদের প্রশিক্ষণ, গোপন মিশন পরিচালনা, সিআইএ সংযোগ।
- অবস্থান: গত কয়েক মাস ধরে ঢাকায় অবস্থান, কভার আইডেন্টিটি “ব্যবসায়ী”।
এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে তিনি নিছক কোনো বাণিজ্যিক কাজে নয়, বরং উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা বা সামরিক মিশনে যুক্ত ছিলেন
১. হঠাৎ মৃত্যু:
হোটেল কর্মীদের বিবরণে সুস্থ-সবল মানুষ হঠাৎ মারা যাওয়াটা সন্দেহজনক। বিষপ্রয়োগ বা টার্গেটেড অপারেশনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
২. দূতাবাসের ভূমিকা:
দ্রুত লাশ সরিয়ে নেওয়া এবং ময়নাতদন্ত এড়িয়ে যাওয়া ইঙ্গিত করে—ঘটনাটি কেবল ব্যক্তিগত মৃত্যু নয়, বরং অপারেশনাল কভার-আপ।
৩. রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার ছায়া:
আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যে বাংলাদেশ একটি সংবেদনশীল জোন। রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি (বর্তমান এফএসবি উত্তরসূরি) দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন কার্যক্রম মনিটর করে আসছে। জ্যাকসনের মৃত্যু রাশিয়ান পাল্টা-অপারেশনের ফল কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
গোপন মিশন ভেস্তে গেলে কিংবা এজেন্ট “বার্ন” হয়ে গেলে সিআইএ বা মার্কিন সেনা সদর দপ্তর সাধারণত দ্রুত ক্ষতিপূরণমূলক পদক্ষেপ নেয়। ইতিহাসে দেখা যায়:
- ইরান (১৯৫৩, অপারেশন অ্যাজাক্স): মোসাদ্দেক উৎখাতের পর ব্যর্থ এজেন্টদের সরিয়ে ফেলা হয়।
- কিউবা (১৯৬১, বে অব পিগস): ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অনেক অপারেটিভকে ত্যাগ করা হয়।
- ধারা: কম্প্রোমাইজড এজেন্টদের মৃত্যু হলে সত্য গোপন রাখা হয়।
ঢাকায় জ্যাকসনের মৃত্যু সেই ঐতিহাসিক ধারা অনুসরণের ইঙ্গিত দেয়।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে ঢাকায় মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেস অফিসারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সম্ভাব্য উদ্দেশ্যগুলো হতে পারে:
- আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব মোকাবেলা, বিশেষত রাশিয়ান ও চীনা প্রভাব।
- স্থানীয় সেনা বা গোয়েন্দা সংযোগ প্রতিষ্ঠা।
- অঘোষিত প্রশিক্ষণ বা মিশন।
জ্যাকসনের মৃত্যু প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ এখনো একটি “গোপন শক্তির খেলার মাঠ”, যেখানে বড় শক্তিগুলো আড়ালে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে।
টেরেন্স আরভেল জ্যাকসনের মৃত্যু নিছক একটি হোটেল-ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বের বহিঃপ্রকাশ। ময়নাতদন্ত এড়িয়ে দূতাবাসের দ্রুত পদক্ষেপ, জ্যাকসনের উচ্চপদস্থ সামরিক ভূমিকা, এবং কেজিবি বা প্রতিদ্বন্দ্বী গোয়েন্দা সংস্থার সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা—সব মিলিয়ে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশে মার্কিন গোপন কার্যক্রম সক্রিয়, এবং সেই কার্যক্রম কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ভেঙে দিয়েছে।
ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতার মাত্রা:
- উচ্চ: জ্যাকসন গুপ্তচরবৃত্তি-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন।
- নিম্ন থেকে মধ্যম: মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অজানা।
ঢাকার ওয়েস্টিনের ৮০৮ নাম্বার কক্ষ তাই এখন শুধু একটি হোটেল রুম নয়—বরং একটি ভূরাজনৈতিক রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু।
