 
                  গাজীপুরের কাশিমপুর শ্মশান মন্দিরে ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। রাষ্ট্রের ভণ্ডামি, মৌলবাদী গোষ্ঠীর মদদ ও সংখ্যালঘু নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ইতিহাস দীর্ঘকালীন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বারবার সনাতনী ধর্মালম্বীদের উপাসনালয়, পূজা মণ্ডপ ও প্রতিমায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা এক গভীর প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে—রাষ্ট্র কি প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, নাকি রাজনৈতিক নাটকের আড়ালে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?
গাজীপুর নগরের কাশিমপুর শ্মশান মন্দিরে প্রস্তুত ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনাটি আবারও সেই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে।
বুধবার বিকেলের এই হামলা স্থানীয় মানুষকে আতঙ্কিত করেছে।
মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে,
পূজা শুরু না হওয়ায় পাহারার ব্যবস্থা করা হয়নি, সিসিটিভিও ছিল না।
ফলে দুর্বৃত্তরা অবাধে প্রবেশ করে প্রতিমা ভেঙে যায়।
এখানে একটি ভয়াবহ বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সুদি ইউনূস এবং সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামান প্রায়ই সনাতনী ধর্মালম্বীদের উপাসনালয় পরিদর্শন করে সম্প্রীতির বুলি আওড়ান।
ক্যামেরার সামনে তারা আশ্বাসের বন্যা বইয়ে দেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন।
কিন্তু বাস্তবে তাদেরই মদদপুষ্ট উগ্রবাদী মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতায় প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দিরে হামলা, পূজামণ্ডপে আগুন দেওয়া—এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।
এ যেন দ্বিমুখী রাজনীতি।
একদিকে সংখ্যালঘুদের সামনে সহানুভূতির মুখোশ, অন্যদিকে ক্ষমতার কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে মৌলবাদীদের ব্যবহার।
এর ফলে বারবার আঘাত হানা হচ্ছে দুর্বল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও নিরাপত্তাবোধে।
কাশিমপুর থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, হয়তো চুরি করতে এসে দুর্বৃত্তরা প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
কিন্তু এই ধরনের বক্তব্য বাস্তবতাকে আড়াল করার এক কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
চুরি করতে এলে কেন শুধু প্রতিমাই ভাঙা হলো?
কেন আশপাশের মূল্যবান সামগ্রী অক্ষত রইল?
পুলিশের দায়সারা মনোভাব আসলে বড় প্রশ্ন জাগায়—রাষ্ট্র কি সত্যিই অপরাধীদের ধরতে আগ্রহী, নাকি কেবল ঘটনাটিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে?
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি থাকলেও বাস্তবে তা বারবার ভঙ্গ হচ্ছে।
প্রতিমা ভাঙচুর শুধু একটি মূর্তি ভাঙা নয়; এটি একটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদার উপর আঘাত।
প্রতিবারের মতো এবারও মন্দির কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে—প্রতিমাগুলো আবার মেরামত করা হবে।
কিন্তু বারবার একই ক্ষত মেরামত করেও কি ক্ষতচিহ্ন মুছে ফেলা সম্ভব?
অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের দ্বিমুখী আচরণ এখন স্পষ্ট।
একদিকে ক্যামেরার সামনে নাটকীয় সম্প্রীতির প্রদর্শনী, অন্যদিকে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত হানার সুযোগ দেওয়া।
এই ভণ্ডামি শুধু সনাতনী সম্প্রদায়কেই নয়, পুরো সমাজের জন্য ভয়াবহ বার্তা বয়ে আনে।
ধর্মীয় আক্রমণ যখন বারবার অমীমাংসিত থাকে, তখন সেটি চিরস্থায়ী ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে, যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
কাশিমপুর শ্মশান মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি ধারাবাহিক আক্রমণের অংশ।
রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামি ও মৌলবাদী মদদপুষ্টতার এই দ্বন্দ্ব যদি অব্যাহত থাকে, তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিজেদের দেশেই নিরাপত্তাহীন থেকে যাবে।
কেবল নিন্দা নয়—প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার, এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা।
অন্যথায় প্রতিমার মতোই ভেঙে পড়বে বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির ভিত্তি।

 
                         
         
         
         
         
        