ইউনূস প্রশাসনের সময়ে এনবিআরের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৩৫ লাখের বিনিময়ে ২৯৯ কোটি টাকার কর মাত্র ৩৩ কোটিতে নামিয়ে আনার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, নজরদারির ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বল জবাবদিহিই এ ধরনের অনিয়মের মূল কারণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতির কেলেঙ্কারির মধ্যে একটি হলো জোবাইদা করিম জুট মিলস লিমিটেড-এর কর মামলা। এখানে নির্ধারিত ২৯৯ কোটি টাকার কর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ অমান্য করে মাত্র ৩৩ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়। এই ঘটনায় অভিযুক্ত হন এনবিআরের দুই কর্মকর্তা—নোয়াখালীর কর অঞ্চলের যুগ্ম কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং ফরিদপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান।
গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে, জাহাঙ্গীর আলম সরাসরি ৩০ লাখ টাকা ঘুষ নেন এবং মাসুদুর রহমান নেন ৫ লাখ টাকা।
প্রক্রিয়াটি এতটাই সাজানো ছিল যে মাত্র দু’দিনের মধ্যে ২৬৬ কোটি টাকার কর ছাড় দেওয়া হয়—যা কেবল অবৈধ নয়, কর প্রশাসনের স্বচ্ছতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তদন্তে দেখা গেছে—
জাহাঙ্গীর আলম কোম্পানিকে কর ছাড়ের আশ্বাস দিয়ে ঘুষ নেন।
পদোন্নতি ও বদলির সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাসুদুর রহমানকে দিয়ে ব্যাক ডেটে অর্ডারশিট তৈরি করান।
কমিশনার বা রেঞ্জ অফিসের অনুমোদন ছাড়াই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়।
অর্থাৎ, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, যেখানে সরকারি কাঠামোকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করা হয়েছে।
শাস্তি হিসেবে—
- জাহাঙ্গীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে (সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৫ ধারা)।
- মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে (শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ১২ ধারা অনুযায়ী)।
এটি নিঃসন্দেহে সরকারের কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এই ব্যবস্থা মূল সমস্যার সমাধান নয়।
কারণ—
- প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি দুর্বল।
- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো অগোছালো।
- দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি নেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও, এর মূল দুর্বলতা হলো কার্যকর তদারকি ও জবাবদিহির অভাব।
এই কারণে—
এনবিআরের মতো সংস্থায় দুর্নীতি সহজেই লুকানো যায়।
ছোট কর্মকর্তার ঘুষ নেওয়া বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ধীরে ধীরে সাংগঠনিক রূপ নেয়।
এমন পরিস্থিতি কেবল সরকারের ভাবমূর্তি নয়, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদুর রহমানের ঘটনাটি শুধু একটি ঘুষ কেলেঙ্কারি নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির গভীর শিকড়ের প্রতিফলন।
শাস্তি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আসল সমাধান হলো—
- এনবিআরে ডিজিটালাইজেশন ও স্বচ্ছতা বাড়ানো।
- কর ব্যবস্থায় বহুমাত্রিক তদারকি নিশ্চিত করা।
- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর কার্যকর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা।
ইউনূস প্রশাসনের এই ঘটনা দেখিয়ে দিল, অন্তর্বর্তী সরকার যতই কঠোর অবস্থান নিক না কেন, যদি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর না করা হয়, তবে দুর্নীতি থেকে মুক্তি মিলবে না।
