গত এক বছরে খুলনার নদী থেকে উদ্ধার হয়েছে অর্ধশতাধিক মরদেহ। অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বাড়ছে, আতঙ্কিত নগরবাসী। রহস্যময় মৃত্যু মিছিল ও সমাধানের পথ নিয়ে বিশ্লেষণ।
খুলনা মহানগরীর নদ-নদীগুলোতে ভেসে আসা মরদেহ এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। গত এক বছরে (আগস্ট ২০২৪ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫) খুলনা ও আশপাশের নদী থেকে নৌ-পুলিশ উদ্ধার করেছে অর্ধশতাধিক মরদেহ। প্রতিটি নিথর দেহ যেন শহরবাসীর মনে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এ ঘটনাগুলো কেবল সাধারণ অপরাধ নয়, বরং সামাজিক নিরাপত্তা, প্রশাসনিক তৎপরতা ও রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলার গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে।
নৌ-পুলিশের তথ্য বলছে, এই সময়ে উদ্ধার হওয়া মরদেহের সংখ্যা ৫০টির বেশি।
এর মধ্যে ৩০টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও অন্তত ২০টি অজ্ঞাত থেকে গেছে।
- রূপসা নদী: ৪০%
- ভৈরব নদী: ৩০%
- পশুর নদী: ২০%
- অন্যান্য নদী: ১০%
লাশগুলোর মধ্যে ৩২ জন পুরুষ, ৭ জন নারী এবং ১১ জন শিশু ছিল।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অজ্ঞাত মরদেহের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।
খুলনায় মরদেহ উদ্ধারের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে লাশ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।
আঙুলের টিস্যু নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও শনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে না।
যদিও সিআইডি ও পিবিআই টিম ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছে, পরিচয় শনাক্ত করতে সময় লাগছে মাসের পর মাস।
ফলে অনেক মরদেহ শেষ পর্যন্ত ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এর মাধ্যমে দাফন করা হচ্ছে।
এতে পরিবার হারানো অনেক মানুষ হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবে না, তাদের প্রিয়জন কোথায় হারিয়ে গেল।
খুলনা নৌ-পুলিশ সুপার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ স্পষ্টভাবে বলেছেন, হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলা এখন অপরাধীদের কাছে নিরাপদ কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানির নিচে লাশ দ্রুত বিকৃত হয়ে যাওয়ায় হত্যার প্রমাণ নষ্ট হয়, আর শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে এই অবস্থায় পুলিশের সীমিত প্রযুক্তি ও দুর্বল নজরদারি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নদীপথে টহল জোরদার ও সিসিটিভি-ভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা ছাড়া কার্যকর সমাধান নেই।
খুলনার নাগরিক নেতা অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা মনে করেন, এ ঘটনা কেবল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ নয়, বরং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও প্রতিফলন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পূর্ণ সক্ষমতা দিয়ে কাজ করতে পারছে না, ফলে অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে।
এটি রাষ্ট্রের ভেতরে আইন ও ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছে।
নগরবাসীর মানসিক অস্থিরতা বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও বিপজ্জনক।
খুলনার নদীগুলোতে একের পর এক মরদেহ উদ্ধার শুধু অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।
এ ঘটনা খুলনার মানুষের মনে এক অদৃশ্য আতঙ্ক তৈরি করছে।
যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই রহস্যময় মৃত্যু মিছিল আগামী দিনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।
