 
                  ঝিনাইদহের শৈলকুপায় দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর ও মলমূত্র ত্যাগের ঘটনায় আটক মনজের আলীকে মানসিক প্রতিবন্ধী দাবি করা হচ্ছে। তবে এটি কি কেবল ভাঙচুর, নাকি হিন্দু সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করার একটি সুপরিকল্পিত বার্তা?
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা শুধুই একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সামাজিক মিলনমেলারও প্রতীক। কিন্তু এবছরে দুর্গোৎসবকে ঘিরে শৈলকুপায় ঘটে গেল এক অস্বস্তিকর ও আতঙ্কজনক ঘটনা। ২৩ সেপ্টেম্বর ভোরে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের হরিতলা সর্বজনীন পূজা মন্দিরে ৬টি প্রতিমা ভাঙচুর এবং মন্দির প্রাঙ্গণে মলমূত্র ত্যাগের ঘটনা জনমনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আটক মনজের আলী প্রতিমাগুলোর মাথা ভেঙে ফেলছেন এবং কিছু অংশ পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছেন।
এই কাজের মধ্য দিয়ে শুধু প্রতিমা নয়, ভেঙে দেওয়া হয়েছে সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের দেয়ালও।
ঘটনার পর স্থানীয়ভাবে একটি প্রচার ছড়িয়ে পড়ে—আটক মনজের আলী নাকি মানসিক প্রতিবন্ধী।
পুলিশও তদন্তাধীন বলে জানিয়েছে।
কিন্তু এখানেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
কারণ—
তিনি নিয়মিত পূজামণ্ডপে আসতেন, খাওয়া-দাওয়াও করতেন।
সিসিটিভিতে তার চলাফেরায় পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
মলমূত্র ত্যাগের ঘটনা নিছক মানসিক অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ নাকি সাম্প্রদায়িক অবমাননা—এ প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাদেশে অতীতে বহুবার দেখা গেছে, প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় অভিযুক্তদের ‘মানসিক রোগী’ আখ্যা দিয়ে তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়েছে।
ফলে প্রকৃত উদ্দেশ্য ও নেপথ্যের শক্তি আড়ালে থেকে যায়।
ঘটনার পরই প্রকাশ্যে এসেছে আরও একটি উদ্বেগজনক দিক—উপজেলার অধিকাংশ পূজামণ্ডপ অরক্ষিত।
পাহারাদার থাকলেও ভোররাতের ফাঁক গলে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে।
দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আনন্দের যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তা মুহূর্তেই বিষাদের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে।
স্থানীয়রা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন—আবারও এমন ঘটনা ঘটতে পারে কি না।
ঘটনার পরপরই খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি, ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
তবে শুধু প্রশাসনিক তৎপরতা যথেষ্ট নয়।
জরুরি ভিত্তিতে মণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা, তদন্তে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং ঘটনাটিকে ‘মানসিক অসুস্থতা’ বলে আড়াল না করার প্রতিশ্রুতি চাইছে স্থানীয়রা।
এই ঘটনা নিছক প্রতিমা ভাঙচুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিফলনও রয়েছে—
হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
দুর্গাপূজার মতো বৃহৎ উৎসবে সহাবস্থানের চিত্র কলঙ্কিত হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ওপর আস্থা টালমাটাল হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান সকল ধর্মের সমান মর্যাদার নিশ্চয়তা দিলেও বাস্তব পরিস্থিতি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।
শৈলকুপার ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ধর্মীয় সহনশীলতা কেবল নীতিগত ঘোষণায় নয়, বরং কার্যকর বাস্তবতায় প্রতিফলিত হতে হবে।
প্রতিবার এমন ঘটনায় মানসিক প্রতিবন্ধকতার আড়ালে সত্য গোপন করা হলে সামাজিক আস্থা ভেঙে পড়বে, এবং উৎসব পরিণত হবে ভয়ের প্রহরে।
কারণ প্রতিমা ভাঙচুর শুধু মাটির মূর্তি ভাঙা নয়, বরং সহাবস্থানের সামাজিক ভরসাকে ভেঙে ফেলার এক গভীর বার্তা।

 
                         
         
         
        