 
                  নিউইয়র্কে জাতিসংঘের পাশের বৈঠকে গাজা সংকট ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে ২১-পয়েন্ট প্রস্তাব — তবে পৃথিবীর প্রভাবশালী তালিকার শীর্ষে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমন্ত্রণ না পেয়ে উথালপাথাল প্রশ্ন।
টুইলার পরিমণ্ডলে, সংবাদপত্রের শিরোনামে এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষণে গত ২৪–২৫ সেপ্টেম্বরে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল — নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক উচ্চস্তরের বৈঠকে আরব ও মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রনায়ককে এনে গাজা যুদ্ধের অবসান ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ওপর ২১-পয়েন্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বৈঠকে অংশ নেন কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক, পাকিস্তান, মিশর, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিরা; মার্কিন বিশেষ দূত সহ সেক্রেটারি অব স্টেটও বৈঠকে ছিলেন। তবে পৃথিবীর প্রভাবশালী তালিকার শীর্ষে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন অনুপস্থিত।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিধারী নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস
— যিনি গত বছরের “The Muslim 500” তালিকায় শীর্ষ ৫০ ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন — এমন একটি বৈঠকে অনুপস্থিত কেন?
তিনি কি আমন্ত্রণ পাননি, নাকি নিজেই অংশগ্রহণ এড়িয়ে গেছেন?
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ থেকে জানা যায়
ড. ইউনূস নিজে ট্রাম্প-আয়োজিত একটি অংশগ্রহণে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে ট্রাম্পকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন; তবু মূল বৈঠকে তাঁর অনুপস্থিতি লক্ষণীয়।
এই অনুপস্থিতিকে আমরা তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকে পড়তে পারি — কূটনৈতিক বাস্তবতা, ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক ও পরিচিতিমূলক সীমাবদ্ধতা, এবং প্রতীকী/নৈতিক ইস্যু।
রাষ্ট্রীয় বৈঠকগুলিতে (বিশেষত যখন বিষয়টি নিরাপত্তা ও যুদ্ধসংক্রান্ত) সাধারণত দেশের প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রীর লেভেলের নেতৃত্বকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়;
রাষ্ট্রদূত ও বিদেশমন্ত্রকের প্রতিনিধিরা প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন চালায়।
ট্রাম্পের বৈঠকেও যে তালিকা প্রকাশিত হলো তা ছিল রাষ্ট্রনায়কদের — কাতার, সৌদি, তুরস্ক ইত্যাদি — যারা সরাসরি অঞ্চলীয় নীতিতে প্রভাবশালী।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে “স্ট্যাটাস-ম্যাচিং” (state-to-state) একটি প্রাকৃতিক নিয়ম; তাই ব্যক্তিত্বের মর্যাদা থাকলেই সব বৈঠকে আমন্ত্রণ নিশ্চিত নয়।
এতে কেবল প্রভাবের মাত্রাই নয়, ক্ষমতার কাঠামো এবং কার্যকর কূটনৈতিক যুক্তিও বিবেচ্য।
ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যবসা, দাতব্য এবং সামাজিক উদ্যোগে গভীরভাবে যুক্ত।
পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে ইসরায়েলি-হালকা সম্পর্কের কাহিনী, ‘Friends of Yunus’-ধাঁচের নানা পরিচয়ও সংবাদবৃত্তে আলোচিত হয়েছে — যা আরেক দফা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
কিছু পক্ষ বলছে, ইসরায়েলের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্কজনিত কারণে তাঁকে আমন্ত্রণ না করা হয়েছে বা তিনি নিজেই অংশ নিতে অনিচ্ছুক।
কিন্তু উচ্চপর্যায়ের বৈঠক-নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এই ধরনের ব্যক্তিগত/নৈতিক বিবেচনা প্রায়ই একটি ভূমিকা রাখে — বিশেষত যখন বৈঠকটি ইসরায়েলের স্বার্থ বিরোধিতা-সংবেদনশীল।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে স্থানীয় সংবাদ অনুযায়ী ড. ইউনূস ট্রাম্পের রিসেপশনে উপস্থিত ছিলেন
—অর্থাৎ সমন্বয়শীলভাবে ব্যক্তিগত উপস্থিতি থাকলেও নির্দিষ্ট কাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ড. ইউনূস একজন সিভিল-সোসাইটি চেনার ও অর্থনৈতিক উদ্ভাবনের চিহ্ন।
তাঁকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্ল্যাটফর্মে দেখতে না পাওয়া এমনও বোঝাতে পারে যে—আঞ্চলিক ক্রীড়াঘরগুলোতে রাষ্ট্রীয় কণ্ঠস্বরই প্রধান ভোক্তার ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তিত্বের কণ্ঠস্বরে যদি নীতিমালা বদলাতে বলা হয়, তাতে সীমাবদ্ধতা রয়ে যায়।
এই ‘প্রতীকী ক্ষত’ কেবল একজন ব্যক্তির মর্যাদা কমায় না — বরং প্রশ্ন তোলে যে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে বেসরকারি নেতারা কতটুকু বিচারের অংশ হতে পারেন।
বিশেষত গাজার মতো মানবিক সংকট যেখানে রাজনৈতিক ও নৈতিক ইস্যু জড়িত, সেখানে কেবল সদস্যরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বরই সবসময় পর্যাপ্ত নয়।
এখানে বেসরকারি ও নাগরিক নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্তি রাজনৈতিক ও মানবিক সমাধানের দিকটিকে সমৃদ্ধ করতে পারে—তবে বাস্তব কূটনীতিতে তা সাদৃশ্যপূর্ণ নয় সব সময়।
ড. ইউনূসের অনুপস্থিতি একদিকে ‘বিস্ময়’ হলেও, অন্যদিকে তা আন্তর্জাতিক কূটনীতির নিয়ম, অংশগ্রহণকারীর স্ট্যাটাস ও বৈঠকের উদ্দেশ্য বিবেচনায় একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখা যায়।
এটি ব্যক্তিগত প্রতিভার অবমূল্যায়ন নয়; বরং এটা স্মরণ করায় যে ‘কোন ঘটনার নেতৃত্ব দেবেন’ এবং ‘কে আমন্ত্রিত হবে’
—এই দুই প্রশ্ন কেবল ব্যক্তিগত মর্যাদা নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্থিতি ও কূটনৈতিক আভিজাত্যের চূড়ান্ত মিশ্রণের উপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশ ও তার প্রতিনিধিরা যদি ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর হিসেবে উপস্থিত থাকতে চায়,
তাহলে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি কণ্ঠকদের মধ্যকার সমন্বয় ও কৌশলগত প্ল্যানিং অনিবার্য।

 
                         
         
         
        