বাংলাদেশে বাউল-ফকির ও আত্মভোলা মানুষদের জীবনের নিরাপত্তা কি নিশ্চিত? সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে দেখা যাচ্ছে, নিরীহ এক ফকিরকে বলপ্রয়োগে চুল কেটে দেওয়ার ঘটনা প্রশ্ন তুলছে—আইন কোথায়? এ বিশ্লেষণে তার উত্তর খোঁজা হলো।
একটা বয়স্ক নিরীহ ফকিরকে কয়েকজন যুবক মিলে টেনে হিঁচড়ে ধরে চুল কেটে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করার মতো শক্তি নেই তার। কেবল অভিশাপ দিয়ে বলছেন—“আল্লা তুই দেহিস।” ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, আবার কেউ কেউ নীরব থেকেছেন। প্রশ্ন হলো—আমরা কি এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে বাউল, ফকির, পাগল কিংবা আত্মভোলা মানুষদের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকারই নেই?
বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে বলে—
ধারা ৩১ ও ৩২: প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মর্যাদার অধিকার রয়েছে।
ধারা ৩৫: কোনো নাগরিককে অমানবিক বা অপমানজনক শাস্তি দেওয়া যাবে না।
অপরদিকে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী:
- কারও শরীরে বল প্রয়োগ করলে তা আসাল্ট (assault) হিসেবে গণ্য হয়।
- জোর করে চুল কেটে দেওয়া, টেনে হিঁচড়ে অপমান করা হলো ক্রিমিনাল ফোর্স (Section 350) ও হিউম্যান ডিগনিটির অবমাননা।
- এ ধরনের কাজের জন্য মামলা হলে শাস্তি হতে পারে কারাদণ্ড ও জরিমানা।
অর্থাৎ আইন আছে, সংবিধান আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ প্রায়শই অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে বাউল-ফকিররা কেবল গান গেয়ে বেড়ানো মানুষ নন।
তারা মানবতাবাদ, সহিষ্ণুতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
অথচ আজকের সমাজে এদের অনেককে “অদ্ভুত” বা “অগ্রহণযোগ্য” হিসেবে দেখা হয়।
কখনো চরমপন্থি গোষ্ঠীর হামলার শিকার হন, কখনো গ্রামীণ সমাজে লাঞ্ছিত হন।
এভাবে একদিকে আমরা বিদেশে গিয়ে বাউল গানকে ইউনেস্কো হেরিটেজ বলে প্রচার করি, অন্যদিকে দেশে তাদের জীবনকে নিরাপদ রাখতেও ব্যর্থ হই।
সামাজিক অসহিষ্ণুতা: ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে মেনে নিতে না পারা।
আইনের প্রয়োগহীনতা: ভুক্তভোগীরা মামলা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পান না।
স্থানীয় ক্ষমতাবানদের প্রভাব: অপরাধীরা রাজনৈতিক বা সামাজিক ছত্রছায়ায় থেকে যায়।
আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাউল-ফকিরদের বিরুদ্ধে যে কোনো হেনস্থা বা সহিংসতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিচার করতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে মানুষ বুঝতে পারে ভিন্ন জীবনধারা কোনো অপরাধ নয়।
শিক্ষা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে বাউল-ফকিরদের অবদানকে সামনে আনতে হবে।
একজন বয়স্ক ফকিরের চুল জোর করে কেটে দেওয়া কেবল তার ব্যক্তিগত অপমান নয়, এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারকে আঘাত করার সমান।
প্রশ্ন একটাই—আমাদের রাষ্ট্র কি বাউল-ফকিরদের রক্ষা করতে প্রস্তুত, নাকি তাদের নিপীড়নের ইতিহাসই চলতে থাকবে?
