জামায়াত নায়েবে আমীরের “৫০ লাখ যুবক ভারতবিরুদ্ধে” দাবি ও ১৯৭১ সংশোধনের চেষ্টা—দেশীয় নিরাপত্তা, ইতিহাস-স্মৃতি ও কূটনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ শাখার নায়েবে আমীর ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের নিউইয়র্কে একটি গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছে—“কমপক্ষে ৫০ লাখ যুবক ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে” এবং যদি ভারত “ঢুকে পড়ে” তবে তা ১৯৭১ সালের ‘মিথ্যা বদনাম’ সারাতে সহায়ক হবে; তখন জামাত “প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করবে—এই কটুক্তিপূর্ণ মন্তব্যটি দেশের রাজনৈতিক—মানসিক স্পেসে নতুন করে তীব্র আলোড়ন তুলে দিয়েছে।
এই ধরনের থাকা-নেওয়া (hyperbolic) ঘোষণা সাধারণত দুই উদ্দেশ্য রাখে—ভিত্তিহীন ভয় সৃষ্টি করে নিজ রাজনৈতিক বেইজকে শক্ত করা এবং দলগত আইডেন্টিটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা।
জামাতের ইতিহাস ও ১৯৭১ বিষয়ক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এমন বক্তব্য রাজনৈতিক ভালোবাসা জাগাতে ও পুরস্কার-পথ উন্মুক্ত করতে চাওয়ার কৌশলও হতে পারে।
তবে উল্টোদিকে, জাতীয়তাবাদী আবেগ ও ১৯৭১-এর স্মৃতি-ক্ষেত্রে এই ভাষা নতুন ভাঙন ও অবমাননার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
১৯৭১—বাংলাদেশের জন্ম, যা বহু পরিবারের রক্ত, ত্যাগ ও গণমনার প্রতীক।
স্বাধীনতা-যুদ্ধের স্মৃতিকে “বদনাম” আখ্যায়িত করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষেই নয়; এটা পুরো জাতির ঐতিহ্য-চেতনার সঙ্গে সংঘর্ষ।
এমন বক্তব্য জনমানসে বিভেদ বাড়ায়, শেখানো ঘৃণাকে বাড়ায় এবং দেশের ঐক্যের ওপর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
ঐতিহাসিক মামলাগুলোর প্রশ্ন-উত্তর আদালত ও গবেষণায় হওয়া উচিত — রাজনৈতিক শ্লেষ ও উস্কানি দিয়ে নয়।
কোন দলই বাস্তবে সীমান্ত পার করে “অন্তর্ব্যাপী যুদ্ধ” বাধাতে পারে—অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতার কারণে—এবং এমন সম্মোহক বক্তব্য যদি বাস্তবে কোন প্ররোচনায় রূপ নিতে চায়, তাহলে সে পরিস্থিতি বাংলাদেশ-ভারত কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বে বিপজ্জনক।
তথাকথিত “৫০ লাখ” সংখ্যাটি প্রায়শই রাজনৈতিক নাটকের অংশ; বাস্তবতায় এ ধরনের হুমকি কেবল সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ায়, বাণিজ্যিক ও জীবনযাত্রার ব্যাঘাত ঘটায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে।
নিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি মনিটর করা ও কূটনীতিকভাবে বিষয়টি হালকাভাবে না নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা/প্রতিক্রিয়া জরুরি।
সরকারকে উচিত—প্রয়োজন হলে কড়া ফৌজদারি ও কূটনৈতিক নোট গ্রহণ, একই সঙ্গে মুক্ত বাকচেতনার সীমা রক্ষা করা।
নাগরিক সমাজকে উচিত—ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া (শোকসভা নয়, যুক্তিতর্ক, স্মৃতি-রক্ষা কর্মসূচি) এবং আইনগত প্রক্রিয়ায় যাওয়া।
উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্যের উত্তরে অবাধ—অশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
দেশভাগ, স্বাধীনতা ও নৈতিকতা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা কেবল একটি রাজনৈতিক দল বা একটি বক্তার পাঠ্যভাগ নয়—এটি জাতির স্মৃতিচারণার, নৈতিক দায়িত্বের এবং ভবিষ্যৎ কূটনীতির বিষয়।
সংস্কৃতিমূলক অসহিষ্ণুতা বা উগ্রপ্রতিবাদ—দুইইই দেশের ক্ষতি করে।
১৯৭১–এর যাদের জীবন—তারাই আমাদের স্বাধীনতার ভূষিত নাম; তাদের অবমাননা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দ্বারা মুছিয়ে ফেলা যাবে না।
রাষ্ট্র, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের কর্তব্য হলো—তথ্যভিত্তিক, দায়িত্বশীল ও সংযত সাংবাদিকতা দিয়ে পরিস্থিতি হালকাভাবে নয় বরং জবাবদিহিমূলকভাবে মোকাবিলা করা।
