ঢাকার গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মেট্রোরেল-৫ (দক্ষিণ লাইন) প্রকল্প ব্যয় সংকট ও রাজনৈতিক অনাগ্রহে স্থগিত হচ্ছে। নগরবাসীর জন্য এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব কী, পড়ুন বিস্তারিত বিশ্লেষণে।
ঢাকার নগর উন্নয়ন ও পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নে সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্পগুলোর একটি ছিল মেট্রোরেল-৫ (দক্ষিণ লাইন)। গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ খবর হলো—ব্যয় কমানো ও পুনর্গঠিত প্রস্তাব দেওয়ার পরও অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে চাইছে না। প্রধান অর্থদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)ও আপাতত এই বিশাল অঙ্কের ঋণে সাড়া দিচ্ছে না।
প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।
এর মধ্যে এডিবি ও কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক যৌথভাবে ৩৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ দিতে রাজি ছিল।
কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় আর্থিক ঝুঁকি ও অগ্রাধিকারভিত্তিক সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পটি একনেকে ওঠানোই হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন—উভয় পক্ষই ইঙ্গিত দিয়েছে যে বর্তমান সরকারের সময়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও জটিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্বাঞ্চলের আবাসিক প্রকল্পগুলিকে সুবিধা দিতে আগের সরকারই এই রুট বেছে নিয়েছিল।
অর্থাৎ রুট পরিকল্পনা ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির সাথে জড়িত।
বর্তমান কমিশনের মতামত হলো—রুটটি যাত্রীসেবার দিক থেকে তেমন কার্যকর নয়, এবং প্রকল্প ব্যয়ও অতিমাত্রায় বেশি।
প্রকল্প বাতিল বা দীর্ঘস্থায়ী স্থগিত হলে নগরবাসী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সমীক্ষা অনুযায়ী,
মেট্রোরেল-৫ চালু হলে বছরে প্রায় ২১ কোটি কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হতো।
৪১ হাজার টন জ্বালানি সাশ্রয় হওয়ার কথা ছিল।
প্রতিদিন রাস্তায় প্রায় এক হাজার গাড়ির চাপ কমে আসতো।
অন্যদিকে, প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যেই ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
এখন প্রকল্প বাতিল হলে এ অর্থ কার্যত জলে যাবে।
ভবিষ্যতে একই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান স্পষ্টভাবে বলেছেন,
“মেট্রো প্রকল্পের রুট পরিকল্পনা হতে হবে যাত্রীসেবার সক্ষমতা অনুযায়ী, রাজনৈতিক সুবিধাভিত্তিক নয়।”
অন্যদিকে প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আব্দুল ওহাব মনে করেন,
এই রুটটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ রাজধানীতে উত্তর-দক্ষিণমুখী যোগাযোগ অবকাঠামো থাকলেও পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ কাঠামো অত্যন্ত সীমিত।
মেট্রোরেল-৫ প্রকল্পটি স্থগিত হওয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নগর উন্নয়ন নীতির অন্তর্নিহিত সংকটকেই প্রকাশ করে।
সরকার বড় অঙ্কের ঋণ নিতে অনাগ্রহী, ফলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প থমকে যাচ্ছে।
আগের সরকারের নেওয়া রুট পরিকল্পনার সাথে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও একনেকে না ওঠানো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
ঢাকার ট্রাফিক সংকট নিরসন, জ্বালানি সাশ্রয় এবং নগর পরিবহন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার জন্য মেট্রোরেল-৫ (দক্ষিণ লাইন) অপরিহার্য ছিল।
কিন্তু ব্যয় ও রুট পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের অনাগ্রহ প্রকল্পটির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো—
বাংলাদেশ কি নগর পরিবহন ব্যবস্থায় টেকসই সমাধানের সুযোগ হারাচ্ছে, নাকি সময় নিয়ে আরও বাস্তবসম্মত ও যাত্রীসেবাভিত্তিক পরিকল্পনার পথে হাঁটছে?
