ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইতিহাস, তার পরিবারে রাজাকার সম্পৃক্ততা, ও স্বাধীনতার চেতনার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে নতুন বিতর্ক। একাত্তরের দিনগুলোর বর্ণনায় উন্মোচিত অন্ধকার অধ্যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসে “বিতর্কিত চরিত্র” বলতে গেলে যাদের নাম উচ্চারিত হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি একজন আলোকচিত্রী ও অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত হলেও, দেশের অভ্যন্তরে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও পারিবারিক অতীত নিয়ে রয়েছে তীব্র বিতর্ক ও নৈতিক প্রশ্ন।
শহীদুল আলমের মা কাজী আনোয়ারা মনসুরের নাম এসেছে একাত্তরের ভয়াল দিনগুলোর নানা বর্ণনায়।
জাহানারা ইমামের কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে উল্লেখ আছে, আনোয়ারা মনসুর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেজর খালেদ মোশাররফের দুই কন্যাকে আটক করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্ধার করতে গেলে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের খবর দেওয়ার চেষ্টা করেন, যা এক রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
এই ঘটনার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়—তাদের পরিবার তখন স্বাধীনতার বিরোধী শিবিরে অবস্থান করছিল।
শহীদুল আলমের মামা ছিলেন রাজাকার নেতা সবুর খান—যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।
পরিবারের এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে শহীদুল আলম নিজেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি ‘দালাল আইন’-এ গ্রেফতার হন এবং যাবজ্জীবন সাজা পান।
যদিও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পান।
স্বাধীনতার পর বিতর্কের ধারাবাহিকতা
স্বাধীনতার পরও তার নানা কর্মকাণ্ড বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
২০১২ সালে শহীদুল আলম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের পক্ষ নিয়ে বিবৃতি দেন, যা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের ক্ষোভের কারণ হয়।
এরপর তিনি একটি চলচ্চিত্রে জিয়াউর রহমানের ভুয়া কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উপস্থাপন করেন।
ইতিহাস বিকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননার অভিযোগে তিনি পুনরায় আলোচনায় আসেন।
শহীদুল আলমের জীবন ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানসিকতার এক প্রতিফলন।
তার পারিবারিক অতীত, রাজনৈতিক মন্তব্য এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—সবকিছু মিলিয়ে তিনি আজও বিতর্কিত।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও শহীদুল আলমের নাম সামনে আসে একটি প্রশ্নের প্রতীক হিসেবে—কে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার পক্ষের, আর কে ইতিহাস বিকৃতির ধারক?
যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার বহন করছে, তাদের কাছে শহীদুল আলমের অতীত ও কর্মকাণ্ড ইতিহাস বিকৃতির এক সতর্কবার্তা।
কারণ ইতিহাস যতই চাপা দেওয়া হোক, তার আলোকচিত্রের মতোই সত্য একদিন আলোয় ফিরে আসে।
