কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারসহ দেশের ১৭টি কারাগার থেকে পালানো ২ হাজারের বেশি বন্দির মধ্যে এখনও অধরা ৭২৮ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও অপরাধী। নির্বাচনের আগে এরা নতুন নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
২০২৫ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে যে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার বীজ রোপিত হয়েছিল, তার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ আজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারসহ দেশের ১৭টি কারাগারে হামলা চালিয়ে যে ২,২৪৭ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও অপরাধী পালিয়ে যায়, তাদের মধ্যে এখনো ৭২৮ জন অধরা। এই পরিসংখ্যান শুধু একটি আইনশৃঙ্খলা সংকট নয়, এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতার প্রতিফলন।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এখন গোটা দেশজুড়ে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা তীব্র, তখন এই ৭২৮ পলাতক অপরাধীর উপস্থিতি ভয়াবহ আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন—
এই জঙ্গিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হয়ে নাশকতা, হত্যাকাণ্ড ও ভোটকেন্দ্র দখলসহ সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে।
বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন “আনসারুল্লাহ বাংলা টিম”, “জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)” ও “নিও-জেএমবি”-এর সক্রিয় সদস্য ছিল।
এদের মুক্ত বিচরণ শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুতর হুমকি।
৬ আগস্ট ২০২৪—এই দিনটি বাংলাদেশের কারা প্রশাসনের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিনগুলোর একটি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিনই কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে হামলা হয়।
উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা সত্ত্বেও শতাধিক বন্দি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যাদের মধ্যে ছিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি, অপহরণকারী এবং জঙ্গি নেতারা।
সেই ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও ৪৪ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এখনো ধরা পড়েনি।
আইজিপি বাহারুল আলম জানিয়েছেন, অনেকেই সম্ভবত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বা নেপালে পালিয়েছে।
আবার কেউ কেউ দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে রয়েছে এবং সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া পরিচয়ে সক্রিয় রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রযুক্তিনির্ভর অভিযান
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং র্যাব ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পলাতক জঙ্গিকে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
বিশেষ করে দুর্ধর্ষ খুনি সাকিব ওরফে বাবু–কে গ্রেপ্তার করায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
তবে এত বিপুল সংখ্যক পলাতক অপরাধীর অবস্থান শনাক্ত করা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, মোবাইল ট্র্যাকিং, সীমান্ত এলাকায় ড্রোন টহল—এসব উদ্যোগ চলমান থাকলেও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক বিভাজন অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা অভিযানের ধারাবাহিকতাকে দুর্বল করছে।
৭২৮ জন ভয়ঙ্কর অপরাধী ও জঙ্গি যখন অধরা, তখন জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে সরকারের অন্যতম বড় পরীক্ষা।
শুধু আইন প্রয়োগ নয়, এই মুহূর্তে প্রয়োজন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের পুনর্গঠন—যাতে কারাগার থেকে শুরু করে সীমান্ত পর্যন্ত প্রতিটি নিরাপত্তা বলয় শক্তিশালী হয়।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক জান্নাত-উল ফরহাদও স্বীকার করেছেন,
“আমরা নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করছি, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও সীমিত সক্ষমতা রয়েছে।”
এই বক্তব্যই প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতরে এখনো সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রেক্ষাপটে এই পলাতক জঙ্গিরা এক সম্ভাব্য ‘অদৃশ্য যুদ্ধ’-এর সৈনিক।
তারা শুধু রাষ্ট্রবিরোধী নয়, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
অতএব, এখন প্রয়োজন শুধু অভিযান নয়—একটি সমন্বিত, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ জাতীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা, যা দেশকে জঙ্গি-সন্ত্রাসের নতুন অধ্যায় থেকে রক্ষা করতে পারে।
