 
                  আইএমএফের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে কর আরোপের বিষয়টি বাংলাদেশে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট কাটানোর পরিবর্তে অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও রাজস্ব ঘাটতি পূরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবার এক বিতর্কিত প্রস্তাব দিয়েছে—প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ওপর কর আরোপ। এই প্রস্তাব ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের শর্ত হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ প্রবাসী পর্যন্ত সবাই একে দেখছেন “অমানবিক”, “অযৌক্তিক” এবং “আত্মঘাতী” সিদ্ধান্ত হিসেবে।
বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রম দিয়ে দেশে পাঠাচ্ছেন কষ্টার্জিত অর্থ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৩০.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৬.৮০% বেশি।
এই রেমিট্যান্সই বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মূল ভিত্তি।
তবে এমন সময়ে রেমিট্যান্সে কর বসানোর প্রস্তাবকে অনেকেই তুলনা করছেন “প্রবাসীদের পেটে লাথি মারা”র সঙ্গে।
আইএমএফের যুক্তি—বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ এখনো জিডিপির তুলনায় অনেক কম।
সুতরাং প্রবাসী আয়কেও কর কাঠামোর আওতায় আনলে রাজস্ব ঘাটতি কমানো যাবে।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা এই প্রস্তাব গ্রহণে আগ্রহী নয়।
এনবিআরের করনীতি বিভাগের সদস্য ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন—
“আইএমএফ অনেক কিছু প্রস্তাব করে।
কিন্তু জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে সব গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
রেমিট্যান্সে কর বসানো আমাদের বাস্তবতায় মানানসই নয়।”
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও বলেন—
“আমাদের দেশে এখন এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
রিজার্ভ সংকট মিটে গেলে, আদর্শ পরিস্থিতি এলে তখন আলোচনা হতে পারে।
আপাতত আমরা রাজি নই।”
রেমিট্যান্সের পাশাপাশি আইএমএফ প্রস্তাব দিয়েছে লোকসানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ন্যূনতম কর দিতে হবে।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার থাকলে ০.৬০% ন্যূনতম কর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এই প্রস্তাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে সতর্ক করেছে ব্যবসায়ী মহল।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন—
“ন্যূনতম করহার বাড়ানো মানে হলো ব্যবসায়ীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ।
এতে উদ্যোক্তাদের মূলধন সংকুচিত হবে, বিনিয়োগ কমবে, এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও বাধাগ্রস্ত হবে।”
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ: “রেমিট্যান্সে কর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত”
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রেমিট্যান্সে কর বসানো বিপরীত ফল বয়ে আনবে।
প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো শুরু করলে সরকারের রিজার্ভ পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে।
তারা বলছেন—
“দেশে যখন বৈদেশিক মুদ্রার একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস রেমিট্যান্স, তখন এটিতে কর বসানো মানে অর্থনীতির গলায় ফাঁস পরানো।”
আগামী অক্টোবরেই ঢাকায় আসছে আইএমএফের পরবর্তী মিশন।
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের আগে তারা রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন শর্ত দিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে—
- সব পণ্য ও সেবার ওপর একক ১৫% ভ্যাটহার
- আয়কর–ভ্যাট–কাস্টমস বিভাগের অটোমেশন ও সমন্বয়
- কর ফাঁকি রোধে তদারকি জোরদার
তবে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন, এখনই এসব শর্ত মানা সম্ভব নয়।
কারণ এতে সামাজিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপ একসঙ্গে তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ তিনটি—রপ্তানি, প্রবাসী আয় এবং কৃষি।
এর মধ্যে রেমিট্যান্স সবচেয়ে স্থিতিশীল উৎস।
আইএমএফের কর প্রস্তাব যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেল পরিহার করে হুন্ডি ব্যবস্থায় ঝুঁকতে পারেন, যা পুরো অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী পরিণতি বয়ে আনবে।
অতএব, সরকারের উচিত—
রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করা, নিরুৎসাহিত করা নয়।

 
                         
         
         
        