নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে থানার মাত্র ১৫০ গজ দূরে মুদি ব্যবসায়ী নারায়ণ পালের গলাকাটা লাশ উদ্ধারে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই ব্যর্থতা কী বার্তা দিচ্ছে—তা নিয়েই বিশ্লেষণ।
নেত্রকোনার শান্ত শহর মোহনগঞ্জে ঘটে যাওয়া নারায়ণ পাল হত্যাকাণ্ড যেন পুরো সমাজব্যবস্থাকে নাড়া দিয়েছে। একদিকে থানার মাত্র ১৫০ গজ দূরে, অন্যদিকে এক সহজ-সরল মুদি ব্যবসায়ী—যার সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল না—তারই গলাকাটা লাশ উদ্ধার হলো নিজের দোকান থেকে। এই ঘটনা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়; এটি প্রশাসনিক অক্ষমতা ও জননিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি কঠিন প্রশ্নচিহ্ন।
মোহনগঞ্জ পৌর এলাকার ‘বসুন্ধরা মার্কেট’—যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ যাতায়াত করে।
এমন জনবহুল এলাকায়, থানার এত কাছে, রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল, অপরাধীরা এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিকেও ভয় করছে না।
পাশের দোকানিরা জানান, নারায়ণ পাল ছিলেন হাসিখুশি, সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ।
তাঁর সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব বা অর্থনৈতিক বিবাদ ছিল না।
অথচ এমন একজন মানুষকেই নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়—এটি স্থানীয় জনমনে এক গভীর অনিরাপত্তার বোধ তৈরি করেছে।
পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে, ক্রাইম সিন ইউনিটও রাতে এসে আলামত নিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—
- এত কাছাকাছি থানার উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কেন তাৎক্ষণিক কোনো টহল বা সন্দেহজনক নড়াচড়া ধরা পড়ল না?
- হত্যাকাণ্ডের আগে বা পরে থানার কোনো টিম কি আশপাশে ছিল না?
- নাকি এটি পরিকল্পিতভাবে এমন এক সময় করা হয়েছে, যখন এলাকায় পুলিশের সক্রিয়তা সর্বনিম্ন ছিল?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে বের করা এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তায় প্রভাব
মোহনগঞ্জের ব্যবসায়ী সমাজ এখন আতঙ্কিত।
মনোহারি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মোল্লা প্রকাশ্যে বলেছেন, “এই ঘটনার পর ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে দোকান বন্ধ করে আগেভাগে চলে যাচ্ছেন।”
এটি শুধু এক দোকানির মৃত্যু নয়; এটি স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার শঙ্কা তৈরি করেছে।
একইসঙ্গে, পরিবার হারিয়েছে উপার্জনক্ষম সদস্যকে—যা গ্রামীণ অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলবে।
পুলিশ এখনো হত্যার মোটিভ স্পষ্ট করতে পারেনি।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি হয়তো
- দোকান লুটের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ ডাকাতির ঘটনা,
- অথবা ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জটিল রূপ,
- এমনকি কোনো অপরাধচক্রের প্রভাব পরীক্ষার কৌশলগত হামলাও হতে পারে।
থানার পাশেই যদি অপরাধীরা এমনভাবে হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে, তবে তারা হয়তো নিশ্চিত—আইন তাদের নাগাল পাবে না।
মোহনগঞ্জের ওসি আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, “তদন্ত চলছে, সিআইডি ক্রাইম সিন ইউনিট আলামত সংগ্রহ করেছে।”
কিন্তু এখন শুধু তদন্ত নয়—প্রয়োজন দ্রুত অপরাধী শনাক্তকরণ ও জনবিশ্বাস পুনরুদ্ধার।
নইলে নাগরিকেরা ভাবতে বাধ্য হবে—থানার পাশে যদি নিরাপত্তা না থাকে, তবে সাধারণ মানুষের ঘরে কি আদৌ আছে?
নারায়ণ পালের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি অপরাধ নয়; এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি নাগরিক আস্থার এক ভয়াবহ পরীক্ষামূলক মুহূর্ত।
এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
অন্যথায়, এই হত্যাকাণ্ড হবে বাংলাদেশের প্রান্তিক শহরগুলোর নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক—যা আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর দাগ ফেলবে।
