 
                  তিন দশকের ব্যবসায়িক উপস্থিতি শেষে বাংলাদেশ ছাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক ব্র্যান্ড পিঅ্যান্ডজি। বৈশ্বিক পুনর্গঠন, উদীয়মান বাজারে মন্দা, এবং বাংলাদেশের ভোক্তা অর্থনীতির সংকট নিয়ে বিশ্লেষণ।
তিন দশকের কার্যক্রম শেষে বাংলাদেশে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (P&G) — যা দেশের দ্রুতবর্ধনশীল ভোক্তা পণ্য (FMCG) বাজারে এক সময়ের নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড নাম ছিল।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
এটি কোম্পানির চলমান দুই বছরের বৈশ্বিক পুনর্গঠন পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমে ৭,০০০ কর্মী ছাঁটাই ও খরচ কমিয়ে ব্যবসায়িক দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের বাজার থেকে এই প্রস্থান শুধু একটি কর্পোরেট পুনর্গঠন নয় —
বরং এটি এক অর্থনৈতিক বার্তা, যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাজার সংকোচন, মুদ্রাস্ফীতি এবং ভোক্তা ক্রয়ক্ষমতার পতনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
১৯৯৪ সালে বাজারে প্রবেশ করে পিঅ্যান্ডজি বাংলাদেশের FMCG সেক্টরে আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ড এনে ভোক্তাদের অভ্যস্ত করে তোলে।
জিলেট, প্যাম্পারস, ওলে, হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, প্যান্টিন, এরিয়াল— এই ব্র্যান্ডগুলো দ্রুত মধ্যবিত্তের পছন্দে পরিণত হয়।
২০২১ সালে কোম্পানিটি প্রাণ গ্রুপের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে হবিগঞ্জে কারখানা স্থাপন করে, যেখানে প্রায় ১০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছিল।
সেই কারখানায় স্থানীয়ভাবে জিলেট রেজর উৎপাদন শুরু হয়— যা বাংলাদেশে ব্র্যান্ডটির প্রথম উৎপাদন উদ্যোগ।
কিন্তু মাত্র চার বছর পরই কারখানার কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
প্রাণ গ্রুপ জানিয়েছে, “পিঅ্যান্ডজি সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে”— যা বাস্তবে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধের ইঙ্গিতই দেয়।
পিঅ্যান্ডজির বৈশ্বিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা এককভাবে বাংলাদেশকে লক্ষ্য করেনি।
তবে উদীয়মান বাজারে বিক্রয় প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, এবং ডলার সংকট বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বড় প্রভাব ফেলেছে।
২০২৪ অর্থবছরে কোম্পানির অর্গানিক বিক্রয় বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১% উদীয়মান বাজারে— যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশে ভোক্তা পণ্যের বাজারে চীনা, ভারতীয় ও স্থানীয় ব্র্যান্ডের প্রতিযোগিতাও পিঅ্যান্ডজির বাজার শেয়ার কমিয়ে দিয়েছে।
এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক জটিলতা (regulatory complexities) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশে কার্যক্রম চালানোকে ক্রমেই কঠিন করে তুলেছে।
ভোক্তা বাজারে প্রভাব
রাজধানীর সুপারশপগুলোতে ইতিমধ্যে দেখা গেছে, প্যাম্পারস, ওরাল-বি, জিলেট ও হুইসপার— এসব পণ্যের মজুদ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
নতুন সরবরাহও বন্ধ হয়ে গেছে পরিবেশক চুক্তি বাতিলের কারণে।
দীর্ঘমেয়াদে এটি ভোক্তা ব্র্যান্ড বৈচিত্র্যে ঘাটতি তৈরি করবে।
একইসঙ্গে, বাংলাদেশি বাজারে স্থানীয় ও আঞ্চলিক ব্র্যান্ডগুলোর জন্য এটি এক নতুন সুযোগ তৈরি করছে— বিশেষ করে হাইজিন ও পার্সোনাল কেয়ার সেগমেন্টে।
পিঅ্যান্ডজি গত দুই বছরেই আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া থেকে কার্যক্রম গুটিয়েছে।
এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকেও প্রস্থান করছে।
এটি স্পষ্ট করে যে, কোম্পানি অলাভজনক বা অস্থিতিশীল বাজার থেকে সরে গিয়ে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মূল বাজারে পুনর্বিনিয়োগের কৌশল নিয়েছে।
এই প্রবণতা শুধু পিঅ্যান্ডজির নয়— বরং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন পুনর্বিন্যাসের নতুন ধারা, যেখানে দক্ষিণ এশিয়া ক্রমে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।
পিঅ্যান্ডজির এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য এক মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা।
এটি শুধু একটি কোম্পানির প্রস্থান নয়, বরং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের প্রতিফলন।
ডলার সংকট, মুনাফা দেশে পাঠানোর জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, এবং বাজার অনিশ্চয়তা— এসব কারণেই এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সতর্ক।
বাংলাদেশের জন্য এটি এক সতর্কবার্তা:
“গ্লোবাল ব্র্যান্ড ধরে রাখার জন্য শুধু বাজার নয়, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশও প্রয়োজন।”
পিঅ্যান্ডজির বাংলাদেশ ত্যাগ কোনো একদিনের সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক বার্তা—
যেখানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বাজার স্বচ্ছতা এবং নীতিগত পূর্বানুমানযোগ্যতা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ যদি এ সংকেতটি সময়মতো না বোঝে, তবে আগামী দিনে আরও বহুজাতিক ব্র্যান্ড এই তালিকায় যোগ দিতে পারে।

 
                         
         
         
        