নওগাঁয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা নিতাই চন্দ্র দাসকে জবাই করে হত্যা, পাশাপাশি নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জে আরও দুইজন নিহত। সাম্প্রতিক দাঙ্গা-পরবর্তী উত্তেজনায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠছে।
নওগাঁ জেলার ধামইরহাটে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠক নিতাই চন্দ্র দাসকে জবাই করে হত্যার ঘটনা স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
৩৫ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা শুধু আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের সক্রিয় সদস্যই ছিলেন না, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং পূজা উদযাপন পরিষদেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন।
এই দ্বৈত ভূমিকা – রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠক হিসেবে – হয়তো তাকে বহুমাত্রিক বিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জুলাই-আগস্টের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে এলাকায় ভয়ভীতি ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
সেই প্রেক্ষাপটে নিতাই চন্দ্র দাসের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বাকবিতণ্ডা ও প্রকাশ্য হুমকির ঘটনাও ঘটে।
নিতাই চন্দ্র দাস এই হুমকির পর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসীর ধারণা, থানায় অভিযোগ জানানোর পরই তাকে অপহরণ করে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।
তার মরদেহ উদ্ধার হয় ফতেপুর-চকগৌরী গ্রামীণ সড়কের ধারে, মাথায় গুরুতর আঘাতের চিহ্নসহ।
নওগাঁর হত্যার একই সময় নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জেও দুই ব্যক্তির মৃত্যুর খবর এসেছে—
- নেত্রকোনা: মুদি দোকানদার নারায়ণ চন্দ্র (৪২) নিজ দোকানে জবাই অবস্থায় পাওয়া গেছেন।
- মানিকগঞ্জ: এনজিও কর্মকর্তা সামায়েল হাসদা (৩০) নিজ বাসায় মৃত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন।
তিনজনই ভিন্ন পেশার মানুষ, কিন্তু তিনজনেরই পরিচয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য।
যদিও পুলিশ প্রাথমিকভাবে মানিকগঞ্জের ঘটনাকে ‘স্ট্রোক’ বলে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তবু সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠছে—এটি কি ধারাবাহিক ভয়ভীতি প্রদর্শনের অংশ?
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রশ্নে আবারও উদ্বেগ
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মন্দির ভাঙচুর ও ধর্মীয় নেতাদের ওপর হুমকির ঘটনা বেড়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর, প্রশাসনিক অস্থিরতা, এবং প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা – এই তিন উপাদান মিলেই এমন হত্যাকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নিতাই চন্দ্র দাস ছিলেন শিক্ষিত, সমাজসেবী ও প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যক্তি।
এমন একজন সংগঠকের প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড শুধু একটি প্রাণহানিই নয়, বরং সম্প্রদায়ভিত্তিক আস্থা ও নিরাপত্তাবোধের ওপর সরাসরি আঘাত।

ধামইরহাট থানার ওসি ইমাম জাফর জানিয়েছেন, “প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাণ্ড বলেই নিশ্চিত।”
তবে হত্যার কারণ ও জড়িতদের পরিচয় সম্পর্কে এখনও কোনো অগ্রগতি নেই।
এই ধীর তদন্ত এবং বিচারহীনতার দীর্ঘ ইতিহাস মানুষকে নিরুৎসাহিত করছে অভিযোগ জানাতে।
অনেকে মনে করছেন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশ যদি সংখ্যালঘু নেতাদের হত্যার ঘটনাকে “রাজনৈতিক ব্যতিক্রম” হিসেবে দেখেন,
তাহলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
নওগাঁ, নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জের ঘটনাগুলো হয়তো বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু সময়, লক্ষ্য এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতার একটি ধারাবাহিক প্যাটার্ন গড়ে উঠছে।
রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও সামাজিক উদাসীনতা যতদিন থাকবে,
নিতাই চন্দ্র দাসের মতো তরুণ সমাজসেবকরা ততদিন
ভয়, প্রতিশোধ ও অন্ধকার রাজনীতির বলি হয়েই যাবে।
