 
                  ১৯৭১ সালের পর প্রথমবার মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ফিটজেরাল্ড চট্টগ্রামে নোঙর করছে। এই সফর শুধু যৌথ মহড়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কৌশলের ইঙ্গিত বহন করছে।
বাংলাদেশের উপকূলবর্তী সমুদ্রসীমা—যেখানে একসময় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন সপ্তম নৌবহর ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের উপস্থিতি এক আতঙ্কের প্রতীক ছিল—সেই একই অঞ্চলে আজ ৫৪ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ফিটজেরাল্ডের শান্তিপূর্ণ নোঙর যেন ইতিহাসের ঘূর্ণিতে এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে এই মার্কিন ডেস্ট্রয়ারের সফরকে অনেকে সামরিক সহযোগিতার এক “রুটিন কার্যক্রম” হিসেবে দেখলেও বাস্তবতা অনেক গভীর।
ইউএসএস ফিটজেরাল্ড কেবল একটি যুদ্ধজাহাজ নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত উপস্থিতির একটি প্রতীক—
যেখানে বঙ্গোপসাগর ক্রমেই নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর—যার নেতৃত্বে ছিল পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে।
সেই উপস্থিতি ছিল স্পষ্টভাবে পাকিস্তানপন্থী এবং ভারতের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা নৌ প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত সেই বহর পিছু হটলেও, ঐ ঘটনার মানসিক ছাপ বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্কের ওপর দীর্ঘদিন স্থায়ী ছিল।
কিন্তু ২০২৫ সালের এই সফর তার সম্পূর্ণ বিপরীত বার্তা বহন করছে।
এবারে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কোনো সামরিক চাপ নয়—
বরং দক্ষিণ এশিয়ায় সমুদ্র নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে টেনে নেওয়া।
চীন বর্তমানে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দর উন্নয়নে সরাসরি বিনিয়োগ করছে।
ফলে বঙ্গোপসাগর কেবল বাণিজ্যপথ নয়, হয়ে উঠছে প্রভাব বিস্তারের মঞ্চ।
ইউএসএস ফিটজেরাল্ডের সফরকে অনেক বিশ্লেষক এই প্রেক্ষাপটে “চীনা প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষার মার্কিন পদক্ষেপ” হিসেবে দেখছেন।
বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও মার্কিন নৌবাহিনীর এই তিন দিনের যৌথ মহড়া—যেখানে জাহাজ পরিচালনা, যোগাযোগ নিরাপত্তা ও সমুদ্র উদ্ধার অনুশীলন থাকবে—যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সফট পাওয়ার কৌশলের অংশ।
একদিকে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, অন্যদিকে কূটনৈতিক বার্তা—বাংলাদেশ এখন আর চীনের একক বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
প্রতিরক্ষা কূটনীতির নতুন অধ্যায়
চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসানের যুক্তরাষ্ট্র সফরই এই মহড়ার ভিত্তি স্থাপন করে।
তার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’ বাংলাদেশকে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
এই প্রেক্ষাপটে ইউএসএস ফিটজেরাল্ডের আগমন কেবল একটি মহড়ার বিষয় নয়—এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে “পুনর্বিন্যাসের সঙ্কেত” দিচ্ছে।
ভারত-চীন প্রতিযোগিতা: যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশকে ভারতের নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে ধরে রাখতে, কিন্তু আবারও চীনের বিরাগভাজন হতে না দিয়ে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখতে।
বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা: জলদস্যুতা, পাচার ও সামুদ্রিক অবৈধ কর্মকাণ্ড দমনে প্রযুক্তি বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সামরিক সম্পর্কের গভীরতা: ১৯৭১ সালের বৈরিতার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে এটি পারস্পরিক বিশ্বাস ও অংশীদারিত্বের নতুন সূচনা।
ইউএসএস ফিটজেরাল্ডের সফরকে শুধু একটি নৌমহড়া বলে ভুল করা যাবে না।
এটি বাংলাদেশের জন্য এক ভূরাজনৈতিক পরীক্ষা, যেখানে তাকে সমুদ্রকূটনীতির সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
১৯৭১ সালে যে বঙ্গোপসাগর ছিল বিশ্বশক্তির সংঘর্ষের প্রতীক, ২০২৫ সালে সেই একই সমুদ্র আবারও হয়ে উঠছে কৌশলগত মিত্রতার প্রতীক।
এই সফর বাংলাদেশের সার্বভৌম অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না; বরং এটি দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশ এখন নিজস্ব কূটনৈতিক ও সামরিক আত্মবিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে—
যেখানে চট্টগ্রামে নোঙর করা একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ আর ভয় নয়, বরং সহযোগিতার প্রতীক।

 
                         
         
         
        