 
                  বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ২৭ হাজার কোটি টাকার J-10C ফাইটার জেট ক্রয় নিয়ে বিতর্ক। ইউরোপীয় প্ল্যাটফর্ম বনাম চীনা জেট—ব্যয়ের তুলনায় কৌশলগত লাভ কতটা?
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাম্প্রতিক ২৭ হাজার কোটি টাকার আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা এখন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে। অনেকেই বলছেন, এত বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় “অতিরিক্ত”, আবার কেউ কেউ একে “ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিনিয়োগ” হিসেবেও দেখছেন।
তবে এই ব্যয়ের আসল চিত্র বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০২১ সালের প্রেক্ষাপটে।
২০২১ সালে বণিক বার্তা-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, তৎকালীন সরকার MRCA (Multi-Role Combat Aircraft) ক্রয়ের জন্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
কিন্তু এরপর থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমেছে প্রায় ৪৩.৫ শতাংশ (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০২৫)।
অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সমন্বয়ে ২০২১ সালের সেই ২৫ হাজার কোটি টাকার বর্তমান সমমূল্য প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
এই হিসেবে বর্তমান ২৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবে পূর্বের তুলনায় সস্তা, ব্যয়বহুল নয়।
২৭ হাজার কোটি টাকার এই ঋণ-ভিত্তিক প্রকল্প অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রতি বছর ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা করে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত চীনকে পরিশোধ করতে হবে।
এই অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশ রেলখাত প্রতি বছর ১,৫০০ কোটি টাকা লোকসান করে।
শুধু সরকারি দুর্নীতি ও রাজস্ব ফাঁকি হিসেবেও ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা গচ্ছা যায় প্রতি বছর।
অর্থাৎ, সামরিকীকরণে এই ব্যয় মোট অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অযৌক্তিক নয়, বরং পরিকল্পিত হলে এটি দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।
২০২১ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে।
তবে বাস্তবতা হলো—রাফাল বা ইউরোফাইটার টাইফুনের মূল্য কাঠামো বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
নিচে কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তির দৃষ্টান্তঃ
| দেশ | মডেল | প্রতি জেটের খরচ | অতিরিক্ত তথ্য | 
|---|---|---|---|
| মিশর | Rafale | $193 মিলিয়ন | Meteor মিসাইল বিক্রি হয়নি | 
| ভারত | Rafale | $250 মিলিয়ন (প্রাক্কলিত) | সম্পূর্ণ প্যাকেজ চুক্তি | 
| ইন্দোনেশিয়া | Rafale | $193 মিলিয়ন | Meteor সহ সম্ভাব্য ডিল | 
| সৌদি আরব (2007) | Typhoon | $128 মিলিয়ন | পুরোনো প্রজন্মের সংস্করণ | 
এই তুলনায় চীনা J-10C যদি ৬০ মিলিয়ন ডলার বেসিক দামে আসে, তবে প্রশিক্ষণ, মিসাইল, মেইন্টেইনেন্স টুলস, স্পেয়ার পার্টস ও পরিবহনসহ প্রতি জেটের গড় খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার।
২০টি জেটের জন্য ৮২০ মিলিয়ন ডলার অনুসঙ্গিক ব্যয় মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
“চীনা পণ্য মানেই সস্তা” — এই ধারণা কতটা ভুল
“চীনা সব জিনিস সস্তা” — এই প্রচলিত ধারণা আধুনিক সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়।
J-10C একটি আধুনিক 4.5 জেনারেশন মাল্টিরোল ফাইটার, যার AESA রাডার, BVR মিসাইল, ফ্লাই-বাই-ওয়্যার সিস্টেম এবং সিগনেচার রিডাকশন প্রযুক্তি—সবই অত্যাধুনিক মানের।
অতএব এর হার্ডওয়্যার, মেইন্টেইনেন্স ও লজিস্টিক খরচ ইউরোপীয় বিমানের কাছাকাছি না হলেও উল্লেখযোগ্য।
২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যখন আঞ্চলিক অর্থনীতিতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে, তখন এই সামরিক বিনিয়োগ দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সক্ষমতা বৃদ্ধির মাইলফলক হতে পারে।
একইসাথে এটি বাংলাদেশকে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ভারসাম্যে একটি মধ্যম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে।
২৭ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প “অযৌক্তিক বিলাসিতা” নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা কৌশল।
যদি স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ, এবং টেকসই মেইন্টেইনেন্স নিশ্চিত করা যায়, তবে এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর ইতিহাসে যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে উঠবে।

 
                         
         
         
        