শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সুদের টাকা না পেয়ে এক ইমামের নেতৃত্বে ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট—ঘটনাটি শুধু অপরাধ নয়, ধর্মীয় নৈতিকতার অবক্ষয়ের ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। সমাজে বেড়ে চলা সুদ ব্যবসা ও ধর্মীয় ভণ্ডামির নতুন প্রতিচ্ছবি এটি।
শেরপুরের নালিতাবাড়ীর জামিরাকান্দা গ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনাটি শুধু একটি অপরাধ নয়—এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ধর্ম, অর্থনীতি ও নৈতিকতার ভয়াবহ সংঘাতের প্রতিচ্ছবি। “সুদের টাকা না পেয়ে” মসজিদের খতিব আমানউল্লাহ মুন্সির নেতৃত্বে একটি পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা আমাদের সমাজের গভীর অসুস্থ বাস্তবতাকে উন্মোচিত করেছে।
ভুক্তভোগী রিতা বেগম শতকরা ১০ টাকা হারে মাসিক সুদে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।
সুদ ও মূলধনের কিছু অংশ পরিশোধ করলেও ইমাম আরও ৮০ হাজার টাকা দাবি করেন।
পরে টাকা দিতে না পারায় ঢাকায় স্বামীর কাছে চলে যান রিতা।
আর এই সুযোগেই দুই দিন ধরে চলে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট।
এমনকি ঘরের টিন, খুঁটি, ইট, রান্নাঘর, নলকূপ—কিছুই রেহাই পায়নি।
এই ঘটনায় চারজন গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতা মসজিদের খতিব আমানউল্লাহ মুন্সি এখনও পলাতক।
প্রশ্ন হচ্ছে—একজন ধর্মীয় নেতা কীভাবে সুদের ব্যবসায় জড়িত হন?
ইসলাম যেখানে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে, সেখানে একজন ইমাম সুদখোরে পরিণত হওয়া সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত উদাহরণ।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ (Informal Credit) বা সুদে টাকা ধার দেওয়া এক পরিচিত বাস্তবতা।
দারিদ্র্য ও ব্যাংকিং সেবার অপ্রাপ্যতা মানুষকে এসব ইমাম, মৌলভী বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ঠেলে দেয়।
ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে তাঁরা হয়ে ওঠেন স্থানীয় সুদখোর, লুটেরা, এমনকি বিচারকও।
এখানে “ইমাম” পরিচয় একধরনের সামাজিক প্রভাব ও নিরাপত্তার বর্ম হিসেবে কাজ করে।
ফলে এই ধরনের অপরাধ প্রায়শই সামাজিক ও আইনি দায় এড়াতে সক্ষম হয়।
ধর্মের অপব্যবহার ও ভণ্ডামি
ইসলামের মূল শিক্ষায় সুদ, অন্যায়, নিপীড়ন ও লোভের বিরুদ্ধে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
কিন্তু একই ধর্মের অনুসারী হয়ে, মসজিদের দায়িত্বে থেকে, একজন ইমামের এই কর্মকাণ্ড ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই ঘটনা দেখায়—ধর্মীয় পোশাক বা পদবী নয়, বরং নৈতিকতাই আসল পরিচয়।
নালিতাবাড়ী থানার ওসি মো. সোহেল রানা জানিয়েছেন, চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে, পলাতক আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।
কিন্তু শুধু গ্রেপ্তারই যথেষ্ট নয়—এই ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে যে, ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের আর্থিক কর্মকাণ্ডের ওপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি নেই।
প্রয়োজন একটি কঠোর নীতিমালা, যাতে ধর্মীয় নেতৃত্বের আড়ালে কেউ ব্যক্তিগত ব্যবসা বা সুদে লেনদেনে জড়াতে না পারেন।
শেরপুরের এই ঘটনা শুধু একটি মামলার বিষয় নয়—এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে সুদখোর অর্থনীতির বিরুদ্ধে এক গভীর সতর্কবার্তা।
যেখানে ধর্মের ভাষায় মানুষকে ন্যায়ের শিক্ষা দেওয়া হয়, সেখানে যদি সেই ধর্মের প্রতিনিধি অন্যায়ের নায়ক হয়ে ওঠেন—তাহলে সমাজে ন্যায়ের ধারণা ভেঙে পড়ে।
এই ইমামের ঘটনা তাই আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের ভঙ্গুরতার প্রতীক—যা এখনই প্রতিরোধ করা জরুরি।
