বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে সেনাবাহিনীর নৈতিকতা, জবাবদিহিতা ও জনদায়বদ্ধতার সংকট রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। প্রয়োজন পেশাদার, স্বচ্ছ ও সংবিধাননিষ্ঠ সামরিক সংস্কৃতি।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মূল দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। কিন্তু যখন সেই বাহিনীর ভেতরেই দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা ও জনআস্থার ঘাটতি দেখা দেয়—তখন প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা আসলে কতটা সুরক্ষিত? সেনাবাহিনীর শক্তি কেবল অস্ত্রে নয়, বরং তাদের নৈতিক বলয় ও জনগণের বিশ্বাসে নিহিত।
বহু দেশেই দেখা গেছে, সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় নিজেদের “জাতীয় স্বার্থ” সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক স্বার্থের সঙ্গে আপস করে ফেলে।
পাকিস্তান, মিশর বা মিয়ানমারের উদাহরণই ধরা যায়—যেখানে সেনাবাহিনী বাইরের অনুদান, জোট-রাজনীতি ও বৈদেশিক কূটনৈতিক স্বার্থে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা হারিয়েছে।
এর ফলাফল এসেছে অনৈতিকতা, দুর্নীতি ও জনবিচ্ছিন্নতার রূপে।
বাংলাদেশও এই বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।
সময় সময় দেখা গেছে—কিছু প্রভাবশালী সামরিক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত জীবনধারা, অবসরোত্তর সুবিধা, বিদেশে বসবাসের আগ্রহ,
এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা—জনগণের মনে প্রশ্ন জাগায়।
সেনাবাহিনী কি সত্যিই জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, নাকি কেবল নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত?
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, প্রভাবশালী মহলের অনিয়ন্ত্রিত সিদ্ধান্ত ও তথ্য-গোপনীয়তার অভাব।
যখন একটি পেশাদার বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা কমে যায়, তখন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও গণতান্ত্রিক কাঠামো উভয়ই দুর্বল হয়।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে—সামরিক শাসন বা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যখন নীতিহীন হয়ে পড়ে, তখন অর্থনীতি, প্রশাসন ও সমাজব্যবস্থা একযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, সামরিক জবাবদিহিতার অভাবে এক সময় রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিকৃত হয়।
ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, স্বচ্ছতার অভাব ও অবৈধ সুবিধাভোগ একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে রূপ নেয়—যা কেবল সেনাবাহিনী নয়, পুরো রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করে।
সামরিক সংস্কারে জরুরি পদক্ষেপ
একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন পেশাদার, দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ সেনাবাহিনী।
এটি কেবল প্রশাসনিক নির্দেশে নয়, বরং সাংবিধানিক সংস্কৃতি ও নাগরিক মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
এজন্য কিছু মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য:
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: সেনা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ও বাজেট ব্যবস্থাপনায় সংসদীয় নজরদারি জোরদার করা।
নীতিনিষ্ঠ নিয়োগ ও পদোন্নতি: ব্যক্তিগত প্রভাব বা রাজনৈতিক আনুগত্যের বদলে যোগ্যতা ও পেশাগত দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া।
অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান: দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে কার্যকর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
বিদেশি মিশনে স্বচ্ছতা: জাতিসংঘ মিশন বা বিদেশি নিয়োগে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বজায় রাখা।
নাগরিক সমাজের ভূমিকা: মিডিয়া, একাডেমিয়া ও নাগরিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সামরিক স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা।
সেনাবাহিনী একটি জাতির গর্ব, কিন্তু সেই গর্ব টেকসই হয় তখনই, যখন তা নৈতিকতায় দৃঢ়, সংবিধানে বিশ্বস্ত ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।
ব্যক্তিগত স্বার্থ, রাজনৈতিক প্রভাব বা বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতার চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে পারলেই একটি শক্তিশালী, সম্মানিত ও গণতান্ত্রিক সামরিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
আজকের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি—একটি নৈতিক, পেশাদার ও সংবিধাননিষ্ঠ সেনাবাহিনী, যা জনগণের আস্থা ও রাষ্ট্রের মর্যাদা উভয়ই রক্ষা করবে।
