চট্টগ্রামে হোন্ডা ব্র্যান্ড আয়োজিত কনসার্টে ‘জয় বাংলা’ ও শেখ হাসিনার নামে স্লোগানকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিবর্ষণ ও আহতের ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে— বাংলাদেশের তরুণ সমাজে রাজনীতির বিভাজন কত গভীর?
চট্টগ্রামের জিইসি কনভেনশন সেন্টারে হোন্ডা আয়োজিত কনসার্টে ‘জয় বাংলা’ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে স্লোগানকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সহিংস পরিণতি নয়— বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভাজনের এক ভয়াবহ প্রতিফলন।
কনসার্ট, বিশেষ করে তরুণদের সমাবেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কোনো নতুন বিষয় নয়।
এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক এবং সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের অংশ।
কিন্তু শুক্রবার রাতে এই স্লোগান মুহূর্তেই রাজনৈতিক সহিংসতায় রূপ নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, যখন কয়েকজন তরুণ ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ হাসিনা’ স্লোগান দেন, তখন উপস্থিত বিএনপিপন্থী কিছু ব্যক্তির সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।
অর্থাৎ, রাজনৈতিক আনুগত্যের বিভাজন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগানও বিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) দাবি— কনসার্টের কোনো অনুমতি ছিল না এবং সেখানে উশৃঙ্খল তরুণরা ভাঙচুর চালায়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, পুলিশের গুলিতে অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন,
যার মধ্যে মো. শরিফ (২৩) গুরুতর অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।
প্রশ্ন হচ্ছে— একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘উশৃঙ্খলতা’ দমন করতে পুলিশের শটগান ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল কি না?
এটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বাভাবিক পদক্ষেপ, নাকি রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীকী প্রদর্শন— তা নিয়ে জনমনে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে বলে— রাষ্ট্র হবে সেক্যুলার; ধর্ম ও রাজনীতি পৃথক থাকবে।
কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক দল ও মতের বিভাজন এখন সাংস্কৃতিক মঞ্চেও প্রভাব বিস্তার করছে।
‘জয় বাংলা’ যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, তেমনি আজ এটি রাজনৈতিক পরিচয়ের চিহ্ন হয়ে উঠেছে।
ফলে কেউ এই স্লোগান দিলে তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শিবিরের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়— যা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য গভীর সংকেত।
তরুণ সমাজ ও ভয়াবহ মেরুকরণ
এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি তরুণ প্রজন্মের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার।
তারা যেখানে বিনোদন খুঁজতে গিয়েছিল, সেখানে পেল রক্ত ও গুলির আতঙ্ক।
রাজনীতির নামেই তরুণদের মধ্যে ঘৃণার প্রাচীর গড়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে সামাজিক অস্থিরতার নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
‘জয় বাংলা’ কোনো দলের নয়— এটি বাংলাদেশের আত্মার প্রতীক।
অথচ বর্তমান বাস্তবতায় এ স্লোগান বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের এই ঘটনা আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—
যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিকে সহনশীলতার পথে না আনা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংস্কৃতি, বিনোদন, এমনকি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাও রাজনীতির সংঘাতে বন্দী হয়ে থাকবে।
