জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও জলকামান নিক্ষেপ কেবল একটি বিক্ষোভ দমন নয়—এটি সরকারের নীতিনির্ধারণে শিক্ষা খাতের প্রতি গভীর অবহেলার প্রতিচ্ছবি। কেন শিক্ষকরা রাস্তায়, আর কেন প্রশাসন তাদের প্রতিপক্ষ?
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আজ রবিবার সকাল থেকে দেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ‘লাগাতার অবস্থান’ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাতা, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি এবং উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার দাবিতে তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেন। কিন্তু দুপুরে পুলিশের লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ছোড়ার ঘটনায় আন্দোলনকারীদের দাবি ও নৈতিক অবস্থানকে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় দমননীতির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।
এমন সময় এই ঘটনাটি ঘটল, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জনগণের আস্থার পুনর্গঠনের কথা বলছে।
কিন্তু শিক্ষকদের—যারা সমাজের চিন্তাশীল স্তম্ভ—তাদের ওপর পুলিশের বলপ্রয়োগ প্রশ্ন তুলছে সরকারের নৈতিক অবস্থান ও প্রশাসনিক সংবেদনশীলতা নিয়ে।
সরকার সম্প্রতি বাড়িভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা দিলেও শিক্ষক সমাজ তা ‘অপর্যাপ্ত ও অবাস্তব’ আখ্যা দিয়েছে।
কারণ এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যেভাবে সীমিত বেতনে জীবনযাপন করেন, তাতে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ও ভাড়াবাজারের সঙ্গে ঘোষিত ভাতা বৃদ্ধির কোনো বাস্তব সম্পর্ক নেই।
তারা চান—মূল বেতনের অন্তত ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাতা, কারণ রাজধানীসহ জেলা শহরে তাদের অধিকাংশই বাসা ভাড়ার বোঝায় পিষ্ট।
একইসঙ্গে চিকিৎসা ও উৎসব ভাতার দাবিও জীবনের বাস্তব প্রেক্ষাপটে যুক্তিযুক্ত।
কিন্তু প্রশাসন তাদের সঙ্গে সংলাপে না গিয়ে ‘শহীদ মিনারে চলে যাওয়ার’ নির্দেশ ও পরে বলপ্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে।
এটি শুধু এক দিনের বিক্ষোভ দমন নয়; এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় শিক্ষকদের অবস্থানের প্রতি এক প্রকার অবমূল্যায়ন।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতকে ‘জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি’ বলা হয় প্রায় সব সরকারের বক্তব্যে।
কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকদের পেশাগত সম্মান ও আর্থিক স্থিতি সব সময়ই নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকারের বাইরে থেকেছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সরকার-অনুমোদিত, কিন্তু সরকারি সুবিধাবঞ্চিত—এই দ্বৈত বাস্তবতা দীর্ঘদিনের।
তাদের দাবি পূরণ না করে বরং তাদের উপর বলপ্রয়োগ করা সরকারের প্রশাসনিক দূরদর্শিতার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক সংবেদনহীনতার প্রতীক।
শিক্ষকদের রাস্তায় নামা—এক গভীর বার্তা
যখন একজন শিক্ষক রাস্তার ধুলোয় বসে তার ন্যায্য দাবি তোলে, সেটি কেবল আর্থিক আন্দোলন নয়; এটি সমাজের নৈতিক ভিত্তির ক্ষয় নির্দেশ করে।
পুলিশি বলপ্রয়োগে হয়তো আজকের অবরোধ সরানো গেছে, কিন্তু ‘আস্থার অবরোধ’ আরও দৃঢ় হলো।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে—
রাষ্ট্র কি তার শ্রেণিকক্ষের মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করতে অক্ষম হয়ে পড়ছে?
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আজ যে শিক্ষককে লাঠিপেটা করা হলো, তিনি কেবল একজন প্রতিবাদী নাগরিক নন—তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কর্মী।
তাকে দমন মানে ভবিষ্যৎকে দমন।
অতএব, এই আন্দোলন প্রশাসনের কাছে নয়, আমাদের সামগ্রিক সমাজচেতনার কাছেও এক পরীক্ষা—আমরা কি এখনো শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াতে জানি?
