সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বিয়েবাড়িতে চেতনানাশক স্প্রে করে পুরো পরিবারকে অচেতন করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনা বাংলাদেশের গ্রামীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্বলতা প্রকাশ করছে।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার কুসুম্বি উত্তরপাড়ায় এক ভয়ংকর ও উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে। বৌ-ভাতের আনন্দ শেষে রাতের নিস্তব্ধতায় পরিবারের সবাইকে চেতনানাশক স্প্রে করে অচেতন করে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ও কাপড়চোপড় লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। শনিবার (১১ অক্টোবর) গভীর রাতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার একটি ভয়াবহ ইঙ্গিত।
চেতনানাশক স্প্রে বা গ্যাস ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটনের ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
একসময় ট্রেনে, বাসে বা হোটেলে এ ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যেত।
কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামীণ জনপদেও, যেখানে মানুষ এখনও বিশ্বাস, আত্মীয়তা ও সামাজিক বন্ধনে ভরসা করে জীবন যাপন করে।
তাড়াশের এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে—অপরাধীরা এখন শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও অত্যাধুনিক অপরাধ কৌশল ব্যবহার করছে।
ঘুমন্ত অবস্থায় পরিবারের সবাইকে অচেতন করে চুরি করা মানে, তারা দীর্ঘ পরিকল্পনা ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
গ্রামের মানুষ সাধারণত স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপরই নির্ভরশীল—পাড়ার পাহারাদার, মসজিদের মাইকে ঘোষণা, কিংবা পারস্পরিক সতর্কতা।
কিন্তু আধুনিক অপরাধ কৌশলের সামনে এসব প্রচলিত পদ্ধতি এখন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
এ ধরনের ঘটনায় দেখা যায়, পুলিশ তদন্তের আগে ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
তাড়াশ থানার ওসি জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন, “অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু এখানেই প্রশ্ন—কেন এই ধরনের ঘটনায় পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মাঠে নামে না?
অভিযোগের অপেক্ষায় থাকলে অপরাধীরা ততক্ষণে বহু দূর পালিয়ে যায়।
মানবিক সংকট: উৎসব থেকে বিপর্যয়
যে বাড়িতে কিছুক্ষণ আগেই ছিল আনন্দ, হাসি, নাচ-গান—সেই বাড়িতেই ভোরে নিস্তব্ধ ঘরে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে সবাই।
একে শুধু অপরাধ নয়, বরং একটি সামাজিক ট্র্যাজেডি বলা যায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বিয়েবাড়ি মানে শুধুই পারিবারিক অনুষ্ঠান নয়—এটি সামাজিক সংহতির প্রতীক।
আর সেই সংহতির মধ্যেই যখন ভয় ঢুকে পড়ে, তখন তা পুরো সমাজের মানসিক নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
স্থানীয় নিরাপত্তা কমিটি গঠন: প্রত্যেক ইউনিয়নে রাতের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ টহল জোরদার করা জরুরি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গ্রামীণ এলাকায় সিসিটিভি, সৌরবিদ্যুৎ চালিত অ্যালার্ম বা মোশন সেন্সর প্রযুক্তি চালু করা যেতে পারে।
অপরাধ মনিটরিং ডাটাবেস: চেতনানাশক ও একই ধরনের অপরাধের ঘটনাগুলোকে একটি জাতীয় পর্যায়ের মনিটরিং সিস্টেমে যুক্ত করা দরকার।
পুলিশের প্রোঅ্যাকটিভ ভূমিকা: অভিযোগের আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিতি ও দ্রুত তদন্ত অপরিহার্য।
তাড়াশের এই চেতনানাশক স্প্রে কেলেঙ্কারি শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়—এটি আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সামাজিক বিশ্বাস ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার ওপর বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
যদি আজ এই ঘটনাকে সাধারণ চুরি বলে হালকাভাবে দেখা হয়, কাল তা আরও বড় অপরাধে রূপ নেবে—তখন হয়তো কেউই নিরাপদ থাকবে না।
