মিরপুরের রূপনগরে প্রিন্টিং কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে আগুনে ৫ জন নিহত হয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা আবারও প্রশ্ন তুলেছে ঢাকার শিল্প এলাকা ও কেমিক্যাল সংরক্ষণ ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে।
রাজধানী ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ মিরপুরের রূপনগরে আবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড—এবার একটি প্রিন্টিং কারখানা ও সংলগ্ন কেমিক্যাল গোডাউনে। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শুরু হওয়া আগুনে এখন পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। দগ্ধ অবস্থায় আরও অন্তত তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।
এই আগুনের ভয়াবহতা শুধুমাত্র প্রাণহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়;
বরং এটি নগর নিরাপত্তা, শিল্প কারখানার নীতিমালা এবং কেমিক্যাল সংরক্ষণের অনিয়ম নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন,
গোডাউনে ৬ থেকে ৭ রকম কেমিক্যাল মজুত ছিল—যার অনেকগুলো “টঙ্গীর কেমিক্যাল” ধরনের দাহ্য উপাদান।
এই মন্তব্য সরাসরি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২০১৯ সালের টঙ্গী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির কথা,
যেখানে কেমিক্যালের আগুন মুহূর্তে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ডজনেরও বেশি মানুষের।
এই পুনরাবৃত্তি কেবল দুর্ঘটনা নয়; এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতীক।
বছর ঘুরে, সরকার বদলে গেলেও কেমিক্যাল গোডাউনগুলোর অবস্থান, লাইসেন্সিং এবং নিরাপত্তা প্রটোকল প্রায় অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ২৫০০টির বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার অর্ধেকেরও বেশি যথাযথ ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেটবিহীন।
রূপনগরের প্রিন্টিং কারখানাটি কোনো প্রকার অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা জরুরি নির্গমন পথ ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছিল—প্রাথমিক তদন্তে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
কেমিক্যাল সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তিন স্তরের নিরাপত্তা নির্দেশনা রয়েছে—(১) ভেন্টিলেশন, (২) সেপারেশন জোন, এবং (৩) নিউট্রালাইজিং ব্যবস্থা।
অথচ বাংলাদেশে অধিকাংশ কারখানাতেই এগুলোর কোনোটি কার্যকর নেই।
“ডিফেন্সিভ কায়দায়” আগুন নিয়ন্ত্রণ মানে কী?
তাজুল ইসলামের ভাষায়, “ডিফেন্সিভ কায়দায় নিউট্রালাইজ করার চেষ্টা চলছে।”
ফায়ার সার্ভিসের এই কৌশল তখনই নেওয়া হয় যখন আগুনের উৎসে প্রবেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে।
অর্থাৎ—এই আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আর পরিস্থিতি যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
২০১০ সালের নিমতলীর পর ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টা—প্রতিটি ট্র্যাজেডির পর সরকারের পক্ষ থেকে “কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর” ঘোষণা এসেছে।
কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঘটেনি।
ব্যবসায়িক স্বার্থ, প্রশাসনিক শিথিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এসব গোডাউন আজও আবাসিক এলাকার ভেতরে জমে উঠেছে।
মিরপুরের এই দুর্ঘটনাও একই ধারাবাহিকতার অংশ, যা বোঝায়—আইন আছে, প্রয়োগ নেই।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
ঢাকায় শিল্প কারখানার লাইসেন্স হয় এক দপ্তর থেকে, বিল্ডিং অনুমোদন অন্য জায়গা থেকে, আর ফায়ার সার্ভিসের সেফটি ছাড়পত্র আবার আলাদা প্রক্রিয়ায়।
এই বিভক্ত প্রশাসনিক কাঠামোই নিরাপত্তাকে করে তুলেছে “দায়হীনতার গোলকধাঁধা।”
মিরপুরের রূপনগরের এই আগুন কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি আমাদের নগরায়ণ ও শিল্প নীতির ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রতীক।
বারবার আগুনে পুড়ে আমাদের নাগরিক সজাগতা জেগে ওঠে, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর আবার সব ভুলে যাই।
এই আগুনের ধোঁয়া শুধু প্রিন্টিং কারখানার ছাদেই নয়, বরং আমাদের অবহেলা ও দায়হীনতার কালো ছায়া হিসেবে পুরো নগর আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
