চট্টগ্রাম বন্দরে গেট ফি ৪০০% পর্যন্ত বাড়ানোয় থমকে গেছে পণ্যবাহী ট্রেইলার চলাচল। প্রাইম মুভার মালিকদের ধর্মঘটে স্থবির আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিপি ওয়ার্ল্ডের স্বার্থে এই বৃদ্ধি—যা দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বন্দরে গেট ফি ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে যে নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা ইতিমধ্যেই বন্দরনির্ভর সমগ্র অর্থনীতিতে অচলাবস্থার আশঙ্কা তৈরি করেছে। গত ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে কার্যকর হওয়া নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী, ভারী যানবাহনের গেট ফি ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩০ টাকা। প্রাইম মুভার মালিক সমিতি এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রতিবাদে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানির হাজার হাজার কনটেইনার বন্দরে আটকে পড়েছে—যা প্রতিদিনের বাণিজ্য প্রবাহে বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮৫ শতাংশের বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
অথচ এই বন্দর এখন নিজেই হয়ে উঠছে ব্যবসায়ীদের জন্য বোঝা।
বাড়তি গেট ফি-র কারণে প্রতি প্রাইম মুভারে প্রতিদিন প্রায় ১৭২ টাকা করে বাড়তি খরচ পড়ছে।
মাস শেষে এই ব্যয় দাঁড়ায় লক্ষাধিক টাকা, যা পণ্যের পরিবহন খরচ ও বাজারমূল্যে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, এমন সময়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যখন মার্কিন বাজারে অতিরিক্ত ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশের পোশাক, পাট ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমছে।
৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্য অর্জন এখন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সোজাসাপ্টা মন্তব্য করেছেন, “চট্টগ্রাম বন্দরে খরচ বাড়ানো মানে আমাদের পণ্যের প্রতিযোগিতামূল্য হ্রাস করা।
এতে লাভবান হবে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো—থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম কিংবা কম্বোডিয়া।”
চট্টগ্রাম চেম্বার, সিপিসিআই এবং প্রাইম মুভার মালিক সমিতির নেতাদের একাংশের দাবি, এই ট্যারিফ বৃদ্ধি মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বন্দর পরিচালনা কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড-এর জন্য ‘পথ পরিষ্কার’ করার অংশ।
নভেম্বরের মধ্যে ডিপি ওয়ার্ল্ড ও সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা, এবং তার আগেই বন্দরের আয়ের কাঠামো বাড়িয়ে “লাভজনক” প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
সিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন,
“বন্দর কোনো লোকসানের মুখে নেই। অথচ ৪১ শতাংশ ফি বাড়ানো হলো কেবল বিদেশি কোম্পানির লাভ বাড়ানোর জন্য—এটা অন্যায় এবং অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত।”
সরকারের অবস্থান ও নীতি প্রশ্নে বিতর্ক
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব বিভাগের প্রধান মো. ওমর ফারুক দাবি করেছেন, “বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো ও সেবা উন্নয়নের জন্যই এই বৃদ্ধি।”
তবে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো পাল্টা বলছে, উন্নয়ন নয়—এটি বেসরকারি বন্দরায়নের প্রথম ধাপ।
যদি সরকার সত্যিই সেবা উন্নয়ন করতে চায়, তবে বন্দর পরিচালনায় স্বচ্ছতা, সময়সাশ্রয় ও ডিজিটাল সিস্টেম নিশ্চিত করুক—মাশুল বাড়িয়ে নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা আসবে।
- রপ্তানি খরচ বাড়বে, ফলে পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়বে।
- আমদানি পণ্য আটকে পড়ায় বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে।
- বন্দরজট বৃদ্ধি পেলে শিপিং কোম্পানিগুলো বিকল্প রুট বেছে নিতে পারে, যা দেশের সুনাম নষ্ট করবে।
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়—এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড।
এই হৃদপিণ্ডে অতিরিক্ত চাপ দিলে গোটা শরীর অসুস্থ হবে, সেটাই এখন দৃশ্যমান।
সরকার যদি অবিলম্বে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনায় না বসে, তবে এই সংকট আমদানি-রপ্তানির গতিপথই নয়, বরং জাতীয় প্রবৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিতে পারে।
