ইউনূস সরকারের প্রচারিত ‘গোলামির চুক্তি’ বাতিলের দাবি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশে চলমান ৪০টিরও বেশি প্রকল্পের মধ্যে বেশিরভাগই যৌথ সিদ্ধান্তে পরিচালিত হচ্ছে—কোনো একতরফা বাতিল হয়নি।
‘গোলামির চুক্তি’ বাতিলের মিথ্যা প্রচার;
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূইয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যে আবারও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন—ইউনূস সরকার নাকি ভারতের সঙ্গে করা ‘গোলামির চুক্তি’ বাতিল করেছে।
কিন্তু প্রকৃত তথ্য বলছে ঠিক তার উল্টো: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) এখনো কার্যকর রয়েছে এবং প্রকল্পগুলোর বাতিল বা পরিবর্তন যৌথ কমিটির অনুমোদনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হচ্ছে, কোনোভাবেই একতরফা নয়।
ভারতীয় ঋণের কাঠামো ও প্রকল্প বাস্তবায়ন
২০১০ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশকে তিন ধাপে মোট ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সুবিধা দিয়েছে, যার সুদের হার মাত্র ১% এবং মেয়াদ ২০ বছর।
এই অর্থ ব্যবহার হচ্ছে রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ, শিল্প, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অবকাঠামো উন্নয়নে।
এ পর্যন্ত (অক্টোবর ২০২৫) প্রায় ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ ছাড় হয়েছে, যা মোট ঋণের ২৫%।
৪০টিরও বেশি প্রকল্পের মধ্যে ১৫টি সম্পন্ন, ৮টি চলমান, বাকিগুলো প্রস্তুতি বা টেন্ডার পর্যায়ে রয়েছে।
এলওসি প্রকল্পের মূল পর্যালোচনা
| ধাপ | বছর | মোট ঋণ (USD) | সম্পন্ন প্রকল্প | চলমান | বাতিল/বিলম্বিত |
|---|---|---|---|---|---|
| প্রথম এলওসি | ২০১০ | ৮৬২ মিলিয়ন | ১২ | ৩ | ০ |
| দ্বিতীয় এলওসি | ২০১৬ | ২ বিলিয়ন | ৪ | ৬ | ৫ |
| তৃতীয় এলওসি | ২০১৭ | ৪.৫ বিলিয়ন | ১ | ৮ | ১১ |
উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে খুলনা–মংলা রেললাইন, টংগী–জয়দেবপুর তৃতীয় ট্র্যাক, বঙ্গবন্ধু রেল ব্রিজ, আশুগঞ্জ–আখাউড়া সড়ক, এবং ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আপগ্রেড।
বাতিলকৃত প্রকল্প: যৌথ সিদ্ধান্ত, একতরফা নয়
২০২৫ সালের মার্চ ও অক্টোবরের রিভিউ মিটিংয়ে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে ১১টি প্রকল্প বাদ দিয়েছে।
বাতিল প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে চট্টগ্রাম বে টার্মিনাল, সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট আধুনিকীকরণ, মংলা পোর্ট আপগ্রেড, মিরসরাই ইকোনমিক জোন ইত্যাদি।
কারণগুলো ছিল—খরচ বৃদ্ধি, ঠিকাদার অনীহা, নিরাপত্তা সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।
অর্থাৎ, কোনো প্রকল্প বাংলাদেশ এককভাবে বাতিল করেনি—বরং এটি ছিল যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি (ইআরডি, ভারতীয় হাই কমিশন, এক্সিম ব্যাংক) কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত।
বাস্তব অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
এলওসি প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের রেলওয়ে, বন্দর ও শিক্ষা খাতে বাস্তব উন্নয়ন এনেছে।
যেমন—
- সিরাজগঞ্জ–আহসানুল্লাহ রেললাইন দেশের পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্য সংযোগ বাড়িয়েছে।
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল ব্রিজ (২০২২) দেশের রেল যোগাযোগে নতুন যুগ সূচনা করেছে।
- ৪৯টি পলিটেকনিকের আধুনিকায়ন ৫০,০০০-এর বেশি শিক্ষার্থীকে সরাসরি উপকৃত করেছে।
এখনও প্রায় ৮টি বড় প্রকল্প চলমান, যার মাধ্যমে আরও ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসছে।
ফলাফল:
ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারিত “গোলামির চুক্তি বাতিল” বক্তব্যটি কেবল রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল।
বাস্তবে ভারতীয় এলওসি প্রকল্পগুলো এখনো সক্রিয়, এবং বাতিল বা সংস্কারের সিদ্ধান্ত সবসময়ই দুই দেশের যৌথ আলোচনার ফল।
বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা কেবল ঋণের সম্পর্ক নয়—এটি দুই প্রতিবেশী দেশের উন্নয়ন-ভিত্তিক পারস্পরিক আস্থার প্রতীক।
