একসময় দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশ্বসেরা স্বীকৃতি পাওয়া রাজশাহী এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত শহর। বৃক্ষ নিধন, জলাশয় ভরাট, ইটভাটা ও নগরায়ণের বিশৃঙ্খলায় হারাচ্ছে নির্মল বায়ুর খ্যাতি।
একসময় বিশ্বের সবচেয়ে পরিষ্কার শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে ছিল রাজশাহী। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা আইকিউএয়ার–এর বায়ুমান সূচকে (Air Quality Index) ২০১৬ সালে রাজশাহীকে দেওয়া হয়েছিল বিশ্বে বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল শহর–এর স্বীকৃতি। কিন্তু মাত্র নয় বছরের ব্যবধানে সেই শহরই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নগরী।
আইকিউএয়ারের আজকের (২০ অক্টোবর ২০২৫) তথ্যমতে, দেশের আট বিভাগীয় শহরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বায়ুমান রেকর্ড হয়েছে রাজশাহীতে – AQI ১৬৭, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’ শ্রেণিতে পড়ে।
খুলনা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে ১৫৭ স্কোর নিয়ে।
বায়ুমান সূচক অনুসারে,
- ০–৫০: ভালো
- ৫১–১০০: সহনীয়
- ১০১–১৫০: সংবেদনশীলদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
- ১৫১–২০০: অস্বাস্থ্যকর
অতএব, রাজশাহীর বর্তমান বায়ু এখন সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি।
রাজশাহীর অবনমনের মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন তিনটি দিক—
নগর সম্প্রসারণের অজুহাতে বৃক্ষ নিধন ও সবুজ বেষ্টনী উচ্ছেদ
জলাশয় ভরাট ও খাল-নদী দখল, ফলে বায়ুপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও ইটভাটার পুনরুত্থান
রাজশাহীর নদীবেষ্টিত ভূপ্রকৃতি অতীতে বাতাসের প্রাকৃতিক চলাচলকে অনুকূল করেছিল।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পদ্মাপাড়ের ধারে উচ্চ ভবন, আবাসন প্রকল্প ও অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে শহরের মাইক্রো-ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ছে।
২০১৬ সালে দ্য গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালের তুলনায় রাজশাহীর বাতাসে ভাসমান ১০ মাইক্রোমিটার ধূলিকণার ঘনত্ব প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে—১৯৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে নেমে এসেছে ৬৩.৯ মাইক্রোগ্রামে।
একই সময়ে পিএম ২.৫ কণার ঘনত্বও অর্ধেকে নেমে আসে।
তবে সেই অর্জন টিকল না।
সাত বছর পর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্যাপস গবেষণা কেন্দ্র দেখায়, রাজশাহী তখনও দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর।
অথচ ২০২৫ সালে এসে একই রাজশাহীই এখন সবচেয়ে দূষিত—যা স্পষ্টতই পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতা হারানোর ইঙ্গিত দেয়।
বায়ুতে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণা PM 2.5 মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এসব কণার উৎস—
- যানবাহনের ধোঁয়া
- ইটভাটা ও কারখানার নির্গমন
- নির্মাণকাজের ধুলা
- কৃষিজ বর্জ্য পোড়ানো
রাজশাহীতে এসব উৎস একযোগে সক্রিয় হয়ে পড়েছে।
কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ প্রায় অকার্যকর।
নগরবাসীর ঝুঁকি ও সতর্কতা
আইকিউএয়ারের পরামর্শ অনুযায়ী এখন রাজশাহীবাসীর করণীয়:
- বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা
- জানালা বন্ধ রাখা, ঘরে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার
- বাইরের ব্যায়াম বা দীর্ঘসময় অবস্থান এড়িয়ে চলা
এগুলো শুধু ব্যক্তিগত সতর্কতা, কিন্তু মূল সমাধান আসবে নগর পরিকল্পনার নীতি পরিবর্তন ও পরিবেশ আইন প্রয়োগে কঠোরতা থেকে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (EPIC)–এর ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫.৫ বছর কমে যাচ্ছে।
এমনকি পুরো দেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকার শীর্ষে।
রাজশাহী একসময় ছিল এই সংকটের বিপরীতে আশা–এর প্রতীক।
আজ সেটিই পরিণত হয়েছে সতর্কবার্তায়।
রাজশাহী প্রমাণ করেছে—পরিবেশ ব্যবস্থাপনা শুধু এককালীন প্রকল্প নয়, বরং তা হতে হবে অব্যাহত রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
বৃক্ষ রোপণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ইটভাটার বিকল্প প্রযুক্তি ছাড়া নগর পুনর্জীবন সম্ভব নয়।
রাজশাহী যদি আবার নির্মল বাতাসের শহর হতে চায়, তবে তাকে ফিরতে হবে প্রকৃতি ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে টেকসই নগর উন্নয়নের পথে।
