নারায়ণগঞ্জে শিশুধর্ষণের অভিযোগে নাইটগার্ড আবু হানিফকে পিটিয়ে হত্যা করেছে জনতা। এই হত্যাকাণ্ড প্রশ্ন তুলছে—ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিতেই কি সমাজ প্রতিশোধের পথে হাঁটছে?
নারায়ণগঞ্জের খানপুরে শিশুধর্ষণের অভিযোগে নাইটগার্ড আবু হানিফকে জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছে—এই ঘটনাটি নিছক এক অপরাধ নয়, বরং সামাজিক আইনহীনতার এক ভয়াবহ উদাহরণ। সোমবার বিকেলে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি জীবনের অবসান নয়, বরং ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনঅবিশ্বাসের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, ৩০ বছর বয়সী আবু হানিফ খানপুর মেইন রোডের ইতু ভিলার নাইটগার্ড ছিলেন।
ভবনের এক ভাড়াটিয়ার ১১ বছরের মেয়েকে ভয় দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
রোববার রাতে মেয়েটি তার মাকে বিষয়টি জানায়, এবং সোমবার দুপুরে তা ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত জনতা হানিফকে ধরে এনে গণপিটুনি দেয়।
বিকেলে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় অভিযুক্তরা, এবং রাতেই তিনি মারা যান।
বাংলাদেশে গণপিটুনি যেন ক্রমেই একটি “অঘোষিত বিচারব্যবস্থা” হয়ে উঠছে।
কেউ চোর, কেউ ধর্ষক, কেউ ছিনতাইকারী—শুধু অভিযোগের ভিত্তিতেই মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে রাস্তায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে সমাজে আইনের প্রতি আস্থা নেই, সেখানে কি প্রতিশোধই নতুন ন্যায়বিচার?
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলো একদিকে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতা তুলে ধরে, অন্যদিকে জনমনে ‘তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ’ নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলে।
কিন্তু এই প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে সমাজের নৈতিক কাঠামো, যেখানে ‘অভিযুক্ত’ আর ‘দোষী প্রমাণিত’—দুইয়ের সীমারেখা হারিয়ে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত: উভয় দিকেই মানবাধিকার লঙ্ঘন
এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দুটি পরিবার—একদিকে ১১ বছরের নির্যাতিত শিশু ও তার মা, অন্যদিকে নিহত নাইটগার্ডের স্ত্রী ও সন্তানরা।
প্রথম পরিবারটি পাচ্ছে না সঠিক মানসিক সহায়তা ও আইনি প্রক্রিয়া, আর দ্বিতীয় পরিবারটি হারিয়েছে উপার্জনক্ষম একজন সদস্যকে।
গণপিটুনি তাই শুধু একজন অভিযুক্তের মৃত্যু নয়, বরং দুইটি পরিবারের চিরস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে।
নারায়ণগঞ্জের মতো শহরে এমন নৃশংস ঘটনাও যখন জনতার হাতে ঘটে, তখন এটি কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি ন্যায়বিচারের কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতীক।
থানার ওসি ও চিকিৎসকদের বিবরণে যে প্রশাসনিক বিলম্ব ও উদাসীনতা প্রকাশ পেয়েছে, তা দেখায় রাষ্ট্রীয় সিস্টেম কীভাবে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮০-১০০ জন গণপিটুনিতে মারা যায়—আইন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী।
কিন্তু এই হত্যাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ দায় স্বীকার করে না, কেউ শাস্তিও পায় না।
ফলে গণপিটুনি ধীরে ধীরে “সামাজিক ন্যায়বিচারের বিকল্প সংস্কৃতি” হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ সংকেত।
নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনাটি আমাদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন রেখে যায়—
“ন্যায়বিচার যদি আদালতে না মেলে, তবে কি রাস্তাই হবে বিচারের মঞ্চ?”
যে সমাজে বিচার বিলম্বিত হয়, সেখানে জনতা নিজেরাই বিচারক হয়ে ওঠে।
কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে—গণরোষ কখনো ন্যায়বিচার দেয় না, বরং অন্যায়ের নতুন রূপ সৃষ্টি করে।
