সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে ১৪ বছরের এক মাদ্রাসাছাত্রীকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে ধর্ষণ, চিৎকার ঢাকতে বাজানো হয় গান। এ ঘটনা কেবল অপরাধ নয়, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার এক নীরব দুপুরে ১৪ বছরের এক মাদ্রাসাছাত্রীকে রাস্তায় থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রেস্তোরাঁয়। দরজা বন্ধ, বাইরে পাঁচজন পাহারায়। ভেতরে উচ্চস্বরে বাজতে থাকে সাউন্ডবক্স—চিৎকার যাতে কেউ না শুনতে পায়। ভেতরের সেই অন্ধকার ঘরে নিভে যায় এক কিশোরীর জীবনের আলো। ঘটনাটি শুধু একটি ধর্ষণ নয়—এটি আমাদের সমাজের নৈতিক দেউলিয়াপনা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং সামাজিক নিরাপত্তার পরিপূর্ণ ব্যর্থতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, নাইম হোসেন (২০) নামে এক যুবক মূল অভিযুক্ত।
সে ভুক্তভোগীকে জোরপূর্বক ‘ডেরা ফাস্টফুড অ্যান্ড চায়নিজ রেস্টুরেন্টে’ নিয়ে যায়।
বাকিরা—ইমরান, আকাশ, আতিক, নাছিম ও নাজমুল—এই পৈশাচিক ঘটনাটির পাহারাদার।
ধর্ষণের সময় রেস্তোরাঁয় জোরে বাজানো হয় গান, যেন পাশের কেউ কিশোরীর আর্তনাদ না শুনতে পায়।
এই নির্মম পরিকল্পনা কেবল একটি অপরাধ নয়; এটি “অপরাধে সংগঠিত সমাজব্যবস্থার” এক ভয়াবহ উদাহরণ,
যেখানে বন্ধুত্ব, বুদ্ধি ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় পাপকে আড়াল করতে।
ধর্ষণের স্থানটি—‘ডেরা ফাস্টফুড অ্যান্ড চায়নিজ রেস্টুরেন্ট’—এমন কোনো গোপন জায়গা নয়, বরং জনবহুল এলাকার একটি পরিচিত আড্ডাস্থল।
কিন্তু সেখানেই দিনের আলোয় সংঘটিত হয় এই ঘৃণ্য অপরাধ।
সাংবাদিকরা গেলে অভিযুক্তদের সহযোগীরা উত্তেজিত হয়ে আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
প্রশ্ন জাগে—এই রেস্তোরাঁ কাদের ছত্রছায়ায় চলত, কারা ছিল তাদের ‘পাহারাদার’?
থানার ওসি জানিয়েছেন, দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার দুর্বল বাস্তবতায় এমন ঘটনাগুলোর পরিণতি প্রায়ই ধোঁয়াশায় মিলিয়ে যায়।
আদালতের কোর্টরুমে সময় কাটে, কিন্তু কিশোরীর চোখে ভয় থেকে যায় সারাজীবন।
ভুক্তভোগীর মা বলেন, “আমার মেয়ে প্রতিদিন মাদ্রাসায় যায়।
সেদিনও গিয়েছিল, কিন্তু আর ফিরল না।”
এই একটি বাক্যেই আছে বাংলাদেশের অসংখ্য মায়ের অব্যক্ত যন্ত্রণা—যারা প্রতিদিন সন্তানকে বাইরে পাঠান ভয় নিয়ে, এবং ফিরিয়ে আনেন ক্ষত-বিক্ষত জীবনের গল্প নিয়ে।
ধর্ষণের পর আমাদের সমাজ যা করে, সেটিও এক প্রকার মানসিক ধর্ষণ—
প্রশ্ন তোলে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে, পরিবারকে লজ্জায় ডুবিয়ে দেয়, অথচ অপরাধীর নাম শিগগিরই হারিয়ে যায় রাজনৈতিক পরিচয়ের জালে।
আইন, নৈতিকতা ও সামাজিক নীরবতা—এক ত্রিমুখী সংকট
বাংলাদেশে প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে ধর্ষণের খবর।
কিন্তু প্রতিটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া একই—একটু ক্ষোভ, কিছু সামাজিক পোস্ট, তারপর নীরবতা।
এই নীরবতা কেবল অপরাধীদের সাহস জোগায় না, বরং রাষ্ট্রের আইনকেও দুর্বল করে।
আমরা ভুলে যাই, ধর্ষণ কেবল শরীরের উপর নয়, এটি একটি সমাজের বিবেকের উপর আঘাত।
যতদিন আমরা প্রতিবাদ না করি, যতদিন আমরা “আমার তো কিছু হয়নি” ভেবে চুপ থাকব, ততদিন এই সাউন্ডবক্সের আওয়াজেই ডুবে যাবে আরেকটি কিশোরীর চিৎকার।
সিরাজগঞ্জের এই ঘটনা কেবল একটি অপরাধ নয়—এটি বাংলাদেশের নারী ও শিশু সুরক্ষার বাস্তবচিত্র।
প্রশাসন যদি এবারও দায় এড়ায়, তাহলে এ দেশ আরেকটি ‘সাউন্ডবক্স সংস্কৃতির’ দিকে ধাবিত হবে, যেখানে অপরাধ ঢাকতে ব্যবহৃত হবে গান, আলো ও চিৎকারহীনতা।
এই কিশোরীর জন্য ন্যায়বিচার মানে কেবল আসামিদের শাস্তি নয়—এটি রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে এক পরীক্ষা, আমরা এখনো মানুষ আছি কি না।
