 
                  চট্টগ্রামের মুরাদপুর উড়ালসড়ক থেকে নাটবল্টু চুরির ঘটনায় নগরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ঝুঁকিতে। তদন্তে উঠে এসেছে ভাসমান মাদকসেবীদের সম্পৃক্ততা। প্রশাসনিক গাফিলতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই বড় হুমকি।
চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর উড়ালসড়কের স্টিল গার্ডার থেকে নাটবল্টু চুরি—শুধু একটি চুরির ঘটনা নয়, এটি নগরের নগরব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সুরক্ষা ও প্রশাসনিক দায়হীনতার এক ভয়াবহ প্রতীক। ২০১৮ সালে ৬৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়ক ছিল চট্টগ্রামের আধুনিক নগর পরিকল্পনার এক নিদর্শন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই প্রকল্পের নিরাপত্তা এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যেখানে এর কাঠামোগত স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
সিটি করপোরেশনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে—জিইসি থেকে বায়েজিদ বোস্তামী সড়কমুখী র্যাম্পে ১৪০টি নাটবল্টু ও ৫৩টি ওয়াশার চুরি হয়ে গেছে।
এই নাটবল্টুগুলোই উড়ালসড়কের স্টিল গার্ডারগুলোর সংযোগ ধরে রাখে, অর্থাৎ এগুলোর অনুপস্থিতি মানেই কাঠামোগত দুর্বলতা।
এমন একটি কাঠামো থেকে নাটবল্টু খুলে নেওয়া বা চুরি করা স্বাভাবিকভাবে ‘অসম্ভবের কাছাকাছি’।
তদন্তে উঠে এসেছে, ভাসমান মাদকসেবীরাই এই ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িত।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের হাতে এমন অপরাধ সংঘটন একদিকে সমাজের নিরাপত্তা সংকটের প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নজরদারির দুর্বলতার প্রকট ইঙ্গিত।
উড়ালসড়কের উচ্চতা ও গঠন জটিলতার কারণে নিয়মিত পরিদর্শনের জন্য ক্রেন বা ম্যান-লিফটের মতো আধুনিক সরঞ্জাম প্রয়োজন—কিন্তু এসবের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট স্পষ্টভাবে বলছে, উড়ালসড়কের রুটিন ইনস্পেকশন কখনোই হয়নি।
এটি শুধু চুরি নয়—একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা।
সরকার বা সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখায় দক্ষ জনবল ও নিয়মিত মনিটরিং না থাকলে এমন বিপর্যয় ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এই উড়ালসড়কের নিচের এলাকা দীর্ঘদিন ধরে মাদকসেবীদের আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিত।
একদিকে নগর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে নিচের অংশে অনিয়ন্ত্রিত দোকান ও অস্থায়ী স্থাপনা, অন্যদিকে পর্যাপ্ত পুলিশি নজরদারির অভাব—
সব মিলিয়ে পুরো এলাকা হয়ে উঠেছে “আইনশৃঙ্খলার অন্ধকার অঞ্চল”।
তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে,
- উড়ালসড়কের নিচের অংশে নিয়মিত অভিযান ও উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে হবে,
- প্রতিটি উড়ালসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ভ্রাম্যমাণ টহল দল নিয়োগ করতে হবে,
- কাঠামোগত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে হবে।
কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের গতি এখনো ধীর।
ফলে চুরি হওয়া নাটবল্টু পুনঃস্থাপন করা হলেও অন্যান্য নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকেই গেছে।
নগর নিরাপত্তার নতুন চিন্তা দরকার
চট্টগ্রাম এখন শুধু যানজট বা জলাবদ্ধতার শহর নয়, এটি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে এক অবকাঠামোগত নিরাপত্তা-ঝুঁকির শহরে।
উড়ালসড়ক, সেতু ও ওভারপাসগুলো নির্মাণের পর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো স্থায়ী পরিকল্পনা নেই।
মুরাদপুর উড়ালসড়কের নাটবল্টু চুরির ঘটনা যেন নগর কর্তৃপক্ষের জন্য এক “সতর্কবার্তা”—নগর উন্নয়ন কেবল নির্মাণে নয়, রক্ষণাবেক্ষণেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
নগরের প্রতিটি উড়ালসড়ক, সেতু ও ফ্লাইওভার শুধু যাতায়াতের পথ নয়, এগুলোই শহরের অর্থনীতি ও জীবনের সঞ্চালনধারা।
কিন্তু যদি সেই কাঠামোই নিরাপদ না থাকে, তাহলে উন্নয়নের মূলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে।
মাদকসেবী বা চোরেরা হয়তো নাটবল্টু খুলছে, কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হলো—আমাদের প্রশাসনিক সিস্টেমের কোন নাটবল্টু এতদিনে ঢিলা হয়ে গেছে?

 
                         
         
         
         
         
        